সাক্ষাৎকার
‘হুমায়ূন আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন’
পরিচয় কবি হিসেবেই, তবে সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও তিনি বেশ সক্রিয়। তাঁর লেখা ছড়া, অনুবাদ, গল্প, শিশুতোষ বইও অনেক জনপ্রিয়। শুধু লেখালেখি নয়, টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে তিনি পেয়েছেন খ্যাতি। তিনি বাংলাদেশের অত্যন্ত পরিচিত ও স্বনামধন্য ব্যক্তি আসাদ চৌধুরী। সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে লেখালেখি ছাড়াও অনেক বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই সাহিত্যিক।
লেখালেখির ভূত কবে থেকে মাথায় চাপল?
আসাদ চৌধুরী : ছোটবেলায় পেনসিল দিয়ে আমি অনেক কিছু লিখেছি। সেগুলোর কথা এখন আমার মনে নেই। ১৯৬১ সালে সংবাদ পত্রিকায় ‘ইতিহাসের আর এক নায়ক’ নামে আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সংবাদ’ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় নয়, এডিটোরিয়াল পাতায় এটা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি আমার কাছ থেকে বিকেলে লেখা নিয়ে গিয়ে পরদিন সকালে সেটা প্রকাশ করেন। সম্ভবত দেরি করতে চাননি বলে এডিটোরিয়াল পাতায় আমার লেখাটি প্রকাশ করেছিলেন। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলে থাকি। হলে ‘সংবাদ’ পত্রিকাটি আমরা রাখতাম। আমার লেখা প্রকাশ হওয়ার পর বন্ধুরা অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। আমিও মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিলাম। পত্রিকায় নিজের নাম বারবার দেখেছিলাম। লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরার সময় প্রকাশিত হলেও আমার পড়ার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই ছিল। ‘আমাদের নবী’ গল্পটি ছোটবেলায় আমি প্রথম পড়েছিলাম। এরপর ‘জলে জঙ্গলে’ ও আরো অনেক অ্যাডভেঞ্চার ও অনুবাদ বই পড়েছি। স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমি প্রথম হয়েছি। আর পুরস্কার হিসেবে বই পেতাম।
কাদের লেখার দ্বারা আপনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
আসাদ চৌধুরী : জসীমউদদীন, বন্দে আলী মিয়া, সুকুমার রায়, কাজী নজরুল ইসলাম আমার অনেক প্রিয় লেখক ছিলেন। তাঁদের লেখা আমাকে অনুপ্রাণিত করত। আমার লেখা প্রথম প্রবন্ধের নাম ছিল ‘সুকুমার রায়।’ ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের গান আমার ভালো লাগত। কিন্তু তাঁর বই আমি অনেক পরে পড়েছি।
আসছে বইমেলায় আপনার লেখা কয়টি বই প্রকাশিত হবে?
আসাদ চৌধুরী : আমার বই এবার একটু বেশি। পুনর্মুদ্রণ বই বেশ কিছু বের হবে। তবে প্রবন্ধের নতুন দুটি বই প্রকাশিত হবে। গত বইমেলায় কবিতার পাঁচটি বই বের হয়েছিল। এবার তুলনামূলক কবিতার বই কম বের হবে। আর বাচ্চাদের জন্য লেখা অনেক বই বের হবে। শিশুতোষ রচনাবলি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড এভাবে বইগুলো বের হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া ‘তোমাদের জন্য পাঁচটি গল্প’ ও ‘তোমাদের জন্য চারটি গল্প’ নামে দুটি বই আসবে। হ্যান্স এন্ডারসনের একটি গল্প অবলম্বনে ‘রাজার নতুন জামা’ নাট্যরূপ দিয়ে আমার একটি বই অনেক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এবার বইটি আবারও প্রকাশিত হবে। পুনর্মুদ্রণ বই হলে অনেক উচ্ছ্বসিত হই আমি।
তরুণ কবিদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
আসাদ চৌধুরী : তরুণ কবিরা এখন ভালো করছেন। তাঁরা অনেক শিক্ষিতও। কবিতায় তাঁরা ফরাসি ও স্প্যানিশ শব্দও ব্যবহার করছেন। তাঁরা অনেক বেশি জীবনসন্ধানী।
প্রাচীন কবিতা পড়ছেন এবং ইতিহাসকে মূল্যায়ন করছেন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি তো এখন অনেক এগিয়ে গেছে। সেটা তাঁরা ব্যবহার করছেন। তবে আন্তরিকভাবে লিখলেও পাঠক বেশি তৈরি করতে পারছেন না। আসলে পাঠক তৈরি করতে সময় লাগে। জীবনানন্দ দাশের পাঠক হতেও অনেক সময় লেগেছিল।
কলকাতার লেখকদের সঙ্গে আপনার অনেক স্মৃতি আছে। তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
আসাদ চৌধুরী : একাত্তরে যুদ্ধের সময় কলকাতার লেখকরা এ দেশের লেখকদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। আমরা এ জন্য তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি মদ-গাঁজা একসময় বেশি খেলেও একাত্তরের সময় একদম এসব কিছু খাইনি। এ জন্য শক্তি চট্টোপাধ্যয় আমাকে মজা করে বলতেন, আমি নাকি সতিপনা করছি। আমার বন্ধু উত্তম দাস মারা গেছেন কিছুদিন আগে। তিনি বিশ্ব বাংলা কবিতা সম্পাদনা করেছিলেন। শ্যামল কান্তি দাস আমার ভালো বন্ধু ছিলেন। সাতচল্লিশের পরে কলকাতার সঙ্গে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও কিছু সাংস্কৃতিক পার্থক্য আমাদের হয়েছে, কিন্তু কলকাতার লেখকরা এখন অনেক বেশি মুম্বাই ও দিল্লিমুখী।
আর একটা বিষয় বলি, কলকাতার সিরিয়ালগুলো দেখলে বোঝা যায় মানবিক মূল্যবোধের কী রকম বিপর্যয় হয়েছে। মানুষ নিজের কেলেঙ্কারি পছন্দ করে না; কিন্তু অন্যের কেলেঙ্কারি পছন্দ করে। এসব সিরিয়ালের গল্প ভালো বিক্রি করা যায়। এই সিরিয়ালগুলো কলকাতায় যেমন প্রবাহিত হয়েছে, তেমনি আমাদের দেশেও হয়েছে।
টেলিভিশনের সঙ্গে প্রথম কবে যুক্ত হলেন? বিটিভি নিয়ে যদি কিছু জানাতেন।
আসাদ চৌধুরী : তখন সাদাকালোর যুগ ছিল। ১৯৬৭ পাকিস্তানি শাসনামলে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একটা কুইজ অনুষ্ঠান করতেন। অনুষ্ঠানের নাম আমি ভুলে গিয়েছি।
অনুষ্ঠানটিতে আমি প্রথম অংশগ্রহণ করেছিলাম। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে, সম্ভবত ১৯৭৪ সালে জিয়া আনসারী, আমার এক বছরের জুনিয়র বন্ধু, আমাকে যে কি না টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতে প্রথম বলেন, জিয়া বলেছিল, ‘আপনি ভালো কথা বলতে পারেন, আবার লিখতেও পারেন। আমরা চাইছি, ভালো ভালো গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে সেটার ওপর একটি অনুষ্ঠান আপনি টিভিতে করুন।’ আমিও প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘শিল্প ও সাহিত্য’।
অনুষ্ঠানটি করার সময় আহমদ ছফা আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ দিতে পারো।’ তখন আমি হুমায়ূন আহমেদের নামও জানি না।
তখন হুমায়ূন আহমেদ অত জনপ্রিয় ছিলেন না। এরপর বাংলাবাজারে গিয়ে একদিন হুমায়ূনের ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটি আমি কিনি। বাসায় এসে এক নিশ্বাসে মনে হয় সেটা পড়ে শেষ করেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, আরে হুমায়ূন আহমেদ তো ভালো লেখেন। পাঠককে ধরে রাখতে জানেন তিনি। এরপর উপন্যাসটির কিছু অংশ আমি নাট্যরূপ দিই। সেই নাটকে অভিনয় করেন অভিনেত্রী মিতা চৌধুরী। সম্ভবত এই নাটক দিয়ে অভিনয় শুরু করেন মিতা। উজ্জ্বল নামের একে ছেলেও অভিনয় করেন। যা হোক তখন বইটির বিক্রিও বেড়ে গিয়েছিল। নাটকটি টিভিতে প্রচারের সময় হুমায়ূন আহমেদ দেশে ছিলেন না। নাটক প্রচার হয়েছে, এটা তাঁর মা আয়েশা ফয়েজ জানতেন। তিনি এটার প্রশংসাও করেছিলেন। এটা আমার ভালো লেগেছিল।
হুমায়ূন বইটির জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর মা আমার কাছেই প্রথম এসেছিলেন। এসব নিয়ে কখনো আমি আলোচনা করিনি।
বিটিভির জনপ্রিয় ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানে আমি হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনের তখন সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। হুমায়ূন আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
কবিতা সবাই ছন্দের তালে পড়েন না। কিন্তু আবৃত্তিশিল্পীরা এ কাজ করেন। অনুষ্ঠানটিতে আমি আবৃত্তিচর্চা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছিলাম। ছবি আঁকার বিষয়টিতেও নজর দিয়েছিলাম। শিল্পী হাশেম খান এ ব্যাপারে আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। আমার মা টেলিভিশনের এ অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেখতেন। কারণ, অনুষ্ঠানের শেষে পুরোনো দিনের গান বাজানো হতো। অনেক বয়স্ক মহিলা, যাঁরা কখনো কারো কাছে চিঠি লিখতেন না, তাঁরা এ অনুষ্ঠানটি দেখে আমার কাছে চিঠি লিখতেন। তাঁরা অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে উপদেশও দিতেন। আমি তাঁদের অনুরোধ ও উপদেশ মেনেছিও। অনুষ্ঠানটিতে ভারতী ঘোষ, সাধন সরকার, নাদিম মাহমুদ বাংলাদেশের গুণীজন যাঁরা টেলিভিশনে আসতেন না, তাঁদের আমি কষ্ট করে নিয়ে এসেছিলাম।
ভাস্কর, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত রায় তাঁরা প্রথম আমার ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছিলেন। কিছু ব্যান্ড শিল্পীকেও অনুষ্ঠানটিতে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তখন আমি সংস্কৃতির অপপ্রচার করছি, এমন অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমি শুধু ভাবতাম, এ সিদ্ধান্ত দর্শক নেবেন! আর আমি বলব, টেলিভিশনে আমার সব প্রযোজক খুব ভালো ছিলেন।
লেখকধন্য বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং নিয়ে কোনো স্মৃতি যদি বলতেন…
আসাদ চৌধুরী : আমি দেখেছি সৈয়দ শামসুল হক বিউটি বোর্ডিংয়ের রুমে বসে অনেক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য করেছেন। বাংলা নাটকের প্রথম মিউজিক ডিরেক্টর সমর দাস তিনি প্রায় প্রতিদিন সেখানে যেতেন। শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরীও যেতেন। শুধু লেখকরা নন, অনেক নায়কও সেখানে যেতেন। তবে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের মতো কবিরা সেখানে বসে থাকলে আমি খুব একটা যেতাম না। দূর থেকে তাঁদের দেখতাম।
জার্মানিতে ডয়েচে ভেলেতে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন।
আসাদ চৌধুরী : প্রথমে বলতে চাই সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানের আমি অনেক ভক্ত। আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর আমাকে সুমন অভিনন্দন জানিয়েছিল। তখন ‘ভয়েস অব জার্মানির’ রেডিওতে আমার একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিল সুমন। আমার পরিবারের সঙ্গেও সুমনের অনেক ভালো সম্পর্ক।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আপনি হতাশ, না আশাবাদী?
আসাদ চৌধুরী : আমি মোটেও হতাশ নই। বিচার বিভাগ সম্পর্কে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল। দুর্নীতি দমন কমিশন আগের থেকে শক্তিশালী হয়েছে। তবে বিচার বিভাগকে নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার থামানোর চেষ্টা করাও হয়েছে। আগেও যাঁরা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন, তাঁরা এটা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজাকারের বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে। এটা অবশ্যই ভালো দিক।