ব্লু হোয়েল : মৃত্যুর আগে যেমন ছিল স্বর্ণার আচরণ
অষ্টম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী ছিল অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ হায়ার সেকেন্ডারি গার্লস স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। সেখানে সব সময় মেধাতালিকায় প্রথম ছিল সে। এর পর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলে।
গত বৃহস্পতিবারের আগপর্যন্ত ‘স্বাভাবিকভাবেই’ চলছিল স্বর্ণার জীবন। অঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার ভোরে। সেদিন ভোর সাড়ে ৬টায় রাজধানীর ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার ৫বি ফ্ল্যাটের বাসা থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর আগে সে সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর ‘ব্লু হোয়েল’ গেমে আসক্ত ছিল বলে বিভিন্ন আলামতের ভিত্তিতে সবার মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে।
মৃত্যুর আগপর্যন্ত কেমন ছিল স্বর্ণার আচরণ, তা জানিয়েছেন তার মা-বাবা। তাঁরা জানান, আত্মহত্যা করার আগের দিন পর্যন্ত খুব স্বাভাবিক আচরণ ছিল স্বর্ণার। তাঁদের চোখে তেমন সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়েনি।
স্বর্ণার বাবা সুব্রত বর্ধন এনটিভি অনলাইনকে জানান, স্বর্ণা রাজ জেগে থাকত আর সকাল ৮টা পর্যন্ত ঘুমাত। এতে তার চেহারা কিছুটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি মেয়েকে প্রতিদিন রাত ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে এবং ভোর সাড়ে ৬টায় উঠতে বলেন।
সুব্রত আরো বলেন, এর পর স্বর্ণা ভোরে ঘুম থেকে উঠত ঠিকই, কিন্তু তার রাত জাগাটা বন্ধ হয়নি। সে সব সময় তার মা-বাবার সঙ্গে ভালো আচরণ করত। মাঝেমধ্যে মা-বাবাকে নিয়ে মজাও করত। কিছুদিন আগে সুব্রতর হাত ভেঙে যাওয়ায় তাঁর স্ত্রী তাকে মুখে ভাত তুলে খাওয়াচ্ছিলেন। সে সময় স্বর্ণা মজা করে মা-বাবার সেই দৃশ্যের ছবি তোলে। এমন অনেক মজাই করত সে।
স্বর্ণার সাজগোজের শখ ছিল। এ জন্য সুব্রত তাকে বিদেশি কসমেটিকস কিনে দেন। মাঝেমধ্যে মায়ের স্বর্ণালংকার ও শাড়ি পরে নানা রকমভাবে সাজত স্বর্ণা। ছবি ও সেলফি তোলার প্রতি আগ্রহ ছিল তার। এসব ছবি সে ফেসবুকে আপলোড করত।
স্বর্ণার ফেসবুক আইডিতে দেখা যায়, গত ৩০ সেপ্টেম্বর নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সে একটি ছবি ও একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করে। সেখানে লেখে, ‘অতঃপর মার কাছ থেকে সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা ছিনিয়ে নেওয়ার পর আয়নার সামনে আমার যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি।‘
এর আগে গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বর্ণার বাবা সুব্রতের জন্মদিন ছিল। সেদিন রাতে স্বর্ণা তাঁর ফেসবুকে বাবাকে নিয়ে একটি পোস্ট দেয়। সেখানে সে লেখে, ‘হ্যাপি বার্থডে মিস্টার সুব্রত বর্ধন… আই লাভ ইউ পাপা… তুমি এমনিতে ভালোই, মাঝে মাঝে একটু বেশিই অ্যাডভাইস দাও… তোমার মোটিভেশনাল স্পিচগুলা শুনতে ভালো লাগে। ট্রিট দিবা কালকে কেএফসিতে, এবার কোনো বাহানা নাই… এভাবেই অলওয়েজ আগলায় রাইখো আমাদের… টাটাহ…।’
স্বর্ণার বাবা বলেন, ‘আমার মেয়ের মুখে কোনোদিন আমি এই গেমটির নাম শুনি নাই। কিন্তু মারা যাওয়ার দিন আমি এ সম্পর্কে শুনি। বাসায় ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে, মনে হয় স্বর্ণা ব্লু হোয়েল গেমসে আসক্ত ছিল। আমার তো কোনো কিছুর অভাব নেই, যখন যেটা চাচ্ছে তখন সেটাই পাচ্ছিল। আমি তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখি নাই। কেবল লক্ষ করতাম যে, রাত জেগে সে ফোন ব্যবহার করত। আর কিছুদিন থেকে ও শুধু ছাদে যেতে চাইত।’
সুব্রত আরো বলেন, ‘ছাদে ও একা একা ঘুরত। এমনকি হঠাৎ হঠাৎ করে ওর ছাদে যাওয়ার নেশা উঠত। বলত, পাপা কী সুন্দর আকাশে চাঁদ উঠছে, চলো ছাদে যাই। রাত ১১টার পর অনেকবার আমি নিজেই তাকে ছাদে নিয়ে গেছি। পূর্ণিমার চাঁদ তার খুব পছন্দ ছিল।’
বৃহস্পতিবারের ঘটনা নিয়ে সুব্রত বলেন, ‘স্বর্ণার ঘরের লক লাগানো থাকত না। ওই দিন ভোর ৬টার দিকে ওর মা ঘুম থেকে ওঠার পরে তার রুমের লক লাগানো দেখতে পায়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পরে সে চাবি দিয়ে দরজা খোলে। এর পর দরজা একটু খুলেই মেয়েকে ফ্যানের সঙ্গে গলায় নাইলনের ওড়নায় পেঁচানো অবস্থায় ঝুলতে দেখে ওর মা। আমি গিয়ে দেখি, খাটের ওপর একটি চেয়ার পড়ে আছে। চেয়ারটি খাটের পশ্চিম পাশে নিচে পড়লেই কাজের মেয়েটি জেগে উঠত। তা যাতে না হয় এবং কোনো শব্দ যাতে না হয় সে জন্য বিছানার ওপর ফেলা হয়েছে চেয়ারটি।’
‘আমি দ্রুত ওড়না কেটে মেয়েকে নিচে নামিয়ে খাটের ওপরে শুইয়ে দিই। ওর জিহ্বা বের করা ছিল, আর চোখগুলো কেমনভাবে যেন তাকানো অবস্থায় ছিল। আর এই ওড়না আমি সিঙ্গাপুর থেকে কিনে এনেছিলাম।’
একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুব্রত। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার মেয়ে সাজতে অনেক পছন্দ করত। ও একটি ওড়না চেয়েছিল, যা ও সব ড্রেসের সঙ্গে পরতে পারবে। আমি সিঙ্গাপুর থেকে ওই ওড়না এনে দিই। ওই ওড়নাতেই সে চিরতরে চলে যাবে এমন জানলে কখনোই আনতাম না ওই ওড়না।’