ম্যালেরিয়া : প্রতিরোধ ও প্রতিকার
বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস আজ। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আমি করব ম্যালেরিয়া নির্মূল’। এই প্রতিপাদ্যের মধ্য দিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান করা হয়েছে।
ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় করণীয় বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪১৮তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : এবারের বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য কী?
উত্তর : এবারের বিষয়টি হলো ‘আমি করব ম্যালেরিয়া নির্মূল’। এই প্রতিপাদ্যের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়, কেবল সরকার নয়, প্রতিটি মানুষের ম্যালেরিয়ার বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেকের অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের মতো দেশে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা আসলে সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া বিষয়টি নিয়ে কোন কোন জিনিস জানা থাকা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : প্রথমত, আমরা যদি বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাকেই দেখি, দেখব, ম্যালেরিয়া প্রধানত পাহাড়ি এলাকায় হতে পারে। কিছুটা হয় নেত্রকোনায়। পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলে হচ্ছে। এর মানে হলো, বর্ডারের যে এলাকাগুলোতে পাহাড় রয়েছে, সেখানে হচ্ছে। বন-জঙ্গলে বেশি হচ্ছে। বাকি যেসব জায়গা রয়েছে, সেগুলোতে সাধারণ এই রোগ পাওয়া যায় না। যেমন—আমি ঢাকায় বসে কথা বলছি। ঢাকায় কিন্তু আমরা সাধারণত ম্যালেরিয়ার রোগী পাই না। যদি কোনো মানুষ ওই অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসে, তখন এটি হতে পারে। ঢাকায় কিন্তু এ ধরনের সমস্যা বেশি পাই না।
প্রশ্ন : ম্যালেরিয়ার লক্ষণ কী?
উত্তর : কেউ ম্যালেরিয়ায় ভুগলে প্রথম দিকে বোঝা কিন্তু খুব কঠিন। একসময় এর কারণে অনেক মৃত্যু হতো। এটি সাধারণ জ্বরের মতোই বেশি তাপমাত্রা নিয়ে আসতে পারে।
সাধারণ ঠান্ডায় যেমন সর্দি-কাশি থাকে, ম্যালেরিয়ায়ও কিন্তু এ রকম হতে পারে। এখানে যেমন ডায়রিয়া বা টাইফয়েডে পেটে ব্যথা থাকে, বমি থাকে, খাওয়ার অরুচি হয়, পায়খানাটা কষা হয়ে যায়, এখানেও তাই হতে পারে।
প্রশ্ন : কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসাকে অনেকে ম্যালেরিয়া ভাবেন। এটি কি ম্যালেরিয়া?
উত্তর : যেকোনো উচ্চমাত্রার জ্বরেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে। এটি অনেকে ভেবে থাকেন। সাধারণত যেকোনো উচ্চজ্বরেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে।
এর মধ্যে শরীরের যেকোনো জায়গায় পুঁজ জমা হয়ে থাকলে এ রকম হতে পারে। যদি আমরা মনে করি নিউমোনিয়া, তখনো এ রকম হতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের সময়ও হতে পারে। এর অর্থ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা মানেই ম্যালেরিয়া নয়।
প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া হয়েছে, বোঝার উপায় কী? চিকিৎসকের কাছে কখন যাওয়া উচিত?
উত্তর : আসলে জ্বরের তাপমাত্রা বেশি থাকলে আমি মনে করি, রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আমরা বললাম যে পাইলোনেফ্রাইটিস। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ অ্যান্টিবায়োটিক কিন্তু রেজিসটেন্স। মানে কাজ করে না। শুরুতেই যদি চিকিৎসা না হয়, সবই কিন্তু বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে।
যখন আমরা দেখি যে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে, সঙ্গে যদি তার ভ্রমণের ইতিহাস থাকে, ভ্রমণের ইতিহাসটা কিন্তু এক মাস আগেও হতে পারে। এর মানে এক-দুই মাস আগেও যদি ভ্রমণের ইতিহাস থাকে, যেগুলো ম্যালেরিয়াপ্রবণ জায়গা, তখন আমরা মনে করি এই রোগী ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত।
আমরা প্রথমে চিন্তা করব, এটি ম্যালেরিয়া কি না। এরপর যে হবে না অন্য রোগীর ক্ষেত্রে তা নয়। তবে এই রোগীর ক্ষেত্রে প্রথমে আমরা চিন্তা করব, ম্যালেরিয়া কি না।
প্রশ্ন : সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া কী?
উত্তর : ম্যালেরিয়ার একটি জটিলতা হলো সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া। এই রোগীগুলো হয়তো প্রলাপ বকতে থাকে। হয়তো তার খিঁচুনি থাকতে পারে। মাঝেমধ্যে হাত-পা প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে। যেহেতু মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করছে, তাই এ রকম হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এই রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় পালস, ব্লাডপ্রেশার কিছুই পাওয়া যায় না। কিডনি খারাপ হয়ে যেতে পারে। লিভার খারাপ হয়ে যেতে পারে। এআরডিএস বলে একটি অবস্থা রয়েছে, এতে শ্বাসকষ্ট হয়ে যেতে পারে। তার অ্যাটাক সব জায়গায় হচ্ছে। পরে যখন রক্ত কণিকাগুলো ভেঙে যায়, ভেঙে যখন গুরুতর অবস্থা হয়, তখন প্রস্রাবের সঙ্গে লাল রক্তের মতো রক্ত যেতে থাকে।
আরেকটি বিষয় রয়েছে, কোষগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে লেগে যায়। এটি শরীরের রক্তনালিগুলো ব্লক করে ফেলে। ব্লক করে দেওয়ার জন্য টিস্যু কোনো রক্ত পায় না। এ কারণে ওই জায়গাগুলো মরে যেতে থাকে। এর মানে, সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া হলে আপনি যদি চিকিৎসা না করেন, তাহলে মৃত্যুর হার ১০০ ভাগ।
প্রশ্ন : সাধারণ ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের চিকিৎসা করে থাকেন?
উত্তর : ২০০৮ সাল থেকে যদি এখন পর্যন্ত চিন্তা করি, ম্যালেরিয়া বাংলাদেশে ৮৮ ভাগ কমে গেছে। সরকারের অবদানের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসকের সক্রিয়তার কারণে কিন্তু এটি হতে পারে। আমাদের সব জায়গায় নেতিবাচকভাবে চিকিৎসকদের উদ্দেশে কথা বলা হয়। কিন্তু দেখেন, ম্যালেরিয়া কিন্তু বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে। গত বছর মাত্র সাড়ে ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অনেক সংস্থাও এগিয়ে এসেছে। বিনামূল্যে মশারি দান করা হয়েছে। প্রায় ১০ কোটি মশারি দান করা হয়েছে।
প্রশ্ন : এ কার্যক্রমগুলো মানুষের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
উত্তর : আপনি যদি পার্বত্য অঞ্চলে যান, দেখবেন, কিছু কিছু জায়গায় যাওয়া খুব কঠিন। সেই জায়গাগুলোতে তো এই পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো যাচ্ছে না। তো আমরা আশাবাদী, আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, আমরা পারব। ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারের লক্ষ্য পূরণ করতে পারব। আশা করি, এটি হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে পরামর্শ কী?
উত্তর : প্রথমে দেখতে হবে কারা ঝুঁকিপ্রবণ। তিন বছরের বাচ্চারা খুব ঝুঁকিপ্রবণ। একজন গর্ভবতী মা ঝুঁকিপ্রবণ। প্রবীণ মানুষ ঝুঁকিপ্রবণ। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা ঝুঁকিতে রয়েছে।
যখন আমরা ওইসব অঞ্চলে যাব, তখন কিছু বিষয় খেয়াল করতে হবে। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এনোফিলিস মশাটা সবচেয়ে বেশি রক্ত শোষণ করে। যতটুকু সম্ভব আমরা গা ঢেকে রাখার চেষ্টা করব। মসকিওটো রিপ্লেন্ট কিনতে পাওয়া যায়। আমরা এগুলো ব্যবহার করতে পারি। কিছু লোশন পাওয়া যায়, এগুলো আমরা লাগাতে পারি। এগুলোর সঙ্গে আমরা ওষুধ খেয়ে নিতে পারি।
ডোক্সিসেকলিনও আমরা খেতে পারি। ভ্রমণে যাওয়ার আগে থেকে শুরু করে ফিরে আসার পর চার সপ্তাহ পর্যন্ত নিয়মিত খেলে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি।
প্রশ্ন : চিকিৎসা যদি পুরোপুরি শেষ না করা হয়, তবে আবার পুরোপুরি করা লাগতে পারে। তখন কীভাবে এটি ব্যবস্থাপনা করেন?
উত্তর : আমরা দেখার চেষ্টা করি এটি কি ট্রিটমেন্ট ফেইলিউর, নাকি রেজিসটেন্স। ট্রিটমেন্ট ফেইলিউর হলে আমরা কুইনিন সমৃদ্ধ চিকিৎসায় চলে যেতে পারি। আর রোগী যদি ওষুধ খেতে না পারে, তখন আমরা ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ দিতে পারি।
প্রশ্ন : কত দিন পর্যন্ত চিকিৎসাটা চলে?
উত্তর : যদি আমরা কুইনিন সালফেট দিই, তখন দেব সাত দিন। আর জটিল হলে তখন আমরা ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিই। কুইনিন ১৪ দিন পর্যন্ত আমরা দিয়ে থাকি। কুইনিনের সমস্যা হলো কিছু জটিলতা তৈরি হয়। এতে কানের মধ্যে সমস্যা হয়, চোখে একটু সমস্যা হয়। এই জন্য যেটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, সেটিই আমরা ব্যবহার করি।