ওষুধ কখন প্রয়োজন? কখন হতে পারে ক্ষতির কারণ?
রোগমুক্তির জন্য আমরা ওষুধ খাই। তবে এ ওষুধই কখনো কখনো ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে। ওষুধ কখন প্রয়োজন আর কখনই বা ক্ষতির কারণ হতে পারে, এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. ফেরদৌস আহমেদ খন্দকার।
বর্তমানে ডা. ফেরদৌস আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইউয়র্কে চিকিৎসা পেশায় সাফল্যের সঙ্গে সেবা দিচ্ছেন। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩৪৫৮তম পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : আপনি যেখানে প্র্যাকটিস করেন, আমেরিকায়, সেখানে কোনো মানুষ চাইলেই কি ওষুধ কিনতে পারে? আর পারলেও কোন ওষুধগুলো কিনতে পারে?
উত্তর : ওষুধ খায়নি এমন মানুষ বাংলাদেশে খুব কম রয়েছে। ওষুধ অনেকটা গাছের সারের মতো। আপনি ফার্টিলাইজার বা ইউরিয়া দিবেন কি না আপনার গাছে, এটি আপনার চিন্তা করে দেখতে হবে। আমি যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে প্র্যাকটিস করি, আমি সেখানে দুই ধরনের রোগীই দেখি। বাংলাদেশি বা সাবকনটিনেন্টাল রোগী এবং বিদেশি রোগী। বাংলাদেশিরা খুব ওষুধ প্রিয়। একটি বা দুটি দিলে হবে না, বেশ ভালো অঙ্কের দিতে হবে। আবার এর ঠিক বিপরীত ছবিও আমি দেখি, পশ্চিমা যেই রোগীগুলো রয়েছে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের তাদের ক্ষেত্রে। বয়স ৪০ হয়েছে, আজ পর্যন্ত, একটি ওষুধও খায়নি এবং খাবে না, এ রকম রোগীও আমি দেখেছি। তো, আসলে সে ছোটবেলা থেকে কীভাবে বড় হয়েছে সেটি আসল কথা। তার জ্বর হয়েছে, সে একটু স্যুপ খাবে, পানি বেশি খাবে, কমলার জুস খাবে।
আর আমাদের দেশে আগেই হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক চায়। আমি অনেককে বলে বোঝাতেই পারলাম না, এখানে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া খুব সহজ। লিখে দিলাম, খান।
প্রশ্ন : ওটিসি ড্রাগ বলে একটি বিষয় রয়েছে। এগুলো চিকিৎসকের চিকিৎসাপত্র ছাড়াও কিনতে পারেন রোগী। সেই ওষুধগুলো কী?
উত্তর : আসলে ওটিসি অর্থ হলো ওভার দ্যা কাউন্টার। এখানে চিকিৎসক বা ফার্মাসিস্টের যুক্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, আপনি রোগী বা ভোক্তা হিসেবে গিয়ে দোকানে বা ফার্মেসিতে অনুরোধ করতে পারেন। বলা যেতে পারে, আমার জ্বর হয়েছে, আপনার কাছে প্যারাসিটামল রয়েছে কি না। এ ধরনের কিছু ওষুধ যেমন : মাথাব্যথার ওষুধ, গ্যাসের ওষুধ, ডায়রিয়ার ওষুধ নিতে পারে। প্রতিটি রোগের দুই ধরনের ওষুধ রয়েছে। একটি হলো হাইঅ্যান্ড, আরেকটি হলো লো অ্যান্ড। লো অ্যান্ড যে ওষুধগুলো, এগুলোকে আমরা ওটিসি বলি। ভাষা কিন্তু এক। বাংলাদেশেও ফার্মেসিতে গেলে দিবে। পশ্চিমা বিশ্বেও আপনি খুঁজে পেতে পারবেন। পার্থক্য হলো ভোক্তা যারা তাদের আচরণগত পার্থক্য।
আমার বাচ্চার যখন জ্বর হলো, আমি গিয়ে ১০টা ওষুধ নিয়ে চলে এলাম। পশ্চিমা একজন রোগী গিয়ে বলবে যে আমার দরকার নেই। আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখেছি যে পানি বেশি পরিমাণে খেলেই চলে যাবে। আমাদের যে মাইন্ডসেট সেটি ওষুধ নির্ভর।
প্রশ্ন : কেউ কেউ ফার্মেসিতে গিয়ে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বলেন, আমাকে ওষুধ দিন। এই যে প্র্যাকটিস, এটি কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে?
উত্তর : দেখুন, আমি প্রথমে যেটি বলছিলাম, ওষুধ একটি রাসায়নিক। কিন্তু আপনার জন্য সুস্থ নয়। এটি অনেকটা ইউরিয়া সারের মতো। আপনাকে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে দিতে হবে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। গাছের একটি নির্দিষ্ট পর্যায় অল্প সময়ের জন্য দিবেন, যেন সে ওই সময়টুকু বেড়ে ওঠে। আমি যদি সারা বছরের জন্য দিয়ে দিই, আপনার গাছের কিন্তু ক্ষতি হবে। ঠিক একই বিষয়। শরীরের মধ্যে অনেক কোষ রয়েছে। আপনি যেই ওষুধটি দিবেন সেটি ক্যামিক্যাল রিয়েকশনের মাধ্যমে, শুধু বাজে কোষকেই সে নষ্ট করবে না, পাশে যে সুস্থ কোষ রয়েছে, একেও সে নষ্ট করবে। তার ভাষা একটিই। আমাকে যেখানে কোডিং করা হয়েছে, আমি সেখানে কাজ করব।
ওষুধেরই ক্রয় ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ক্রিয়ার কারণে হয়তো আপনার জ্বর ভালো হয়ে যাচ্ছে, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণে সারা শরীরে আপনার প্রভাবটি রয়ে যাচ্ছে। আপনার কাছে আজকে মনে হচ্ছে আমি ভালো আছি, কিন্তু পরে এ অ্যান্টিবায়োটিকটি কাজ করবে না। তাই যেকোনো ওষুধই খাবার আগে তিনবার চিন্তা করুন, আপনার ওষুধটি প্রয়োজন রয়েছে কি না। কতদিনের জন্য প্রয়োজন। ক্রিয়ার সঙ্গে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। আপনি যেহেতু রোগী, আপনি যেহেতু ভোক্তা, আপনার ওপরই এ রাসায়নিক পদার্থটি কাজ করছে। আপনি কিন্তু ভুক্তভোগী হবেন। আমি চিকিৎসক হিসেবে বলে দিতে পারব, এটি খাবেন না। আপনি তারপরও যদি খান, দায়িত্ব আপনার। আপনি চিন্তা করে দেখুন, বাবা হিসেবে আপনি একটি রাসায়নিক পদার্থ আপনার শিশুর মুখে দিচ্ছেন, আপনি জানেনও না— কী দিচ্ছেন।
একটি নিয়মের মধ্যে চলুন। অনেকে বলে আমি ভিটামিন খাব। ভিটামিনের সাধারণত কোনো অসুবিধা নেই, পায়খানার সঙ্গে চলে যায়।
তবে ওয়াটার সলিউবলটা বের হচ্ছে, কিন্তু ফ্যাট সলিউবলটা বসে রয়েছে শরীরে। তো আপনি বলছেন, কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু অসুবিধা রয়েছে। আসলে একেবারে যে ওষুধ বা রাসায়নিকের প্রয়োজন নেই, যাবেন না সেই ওষুধে। অনেকে ৪০ বছর হয়ে গেছে ভিটামিন খাওয়া শুরু করে দিল, ভাই ধৈর্য ধরুন। যখন লাগবে, চিকিৎসক বলবে। অথবা চিকিৎসক যদি বলেও আপনি ভোক্তা হিসেবে জিজ্ঞেস করুন, আমার কি আসলেই এর প্রয়োজন রয়েছে। না কি এসব উপাদানগুলো আমি আমার খাবারের মধ্য থেকে পেতে পারি। আপনি নিজ থেকে আমন্ত্রণ জানাবেন না। শরীর আপনার, আমি গাইড করব।
প্রশ্ন : কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলো রোগীরা সারা জীবন কিনে কিনে খান। যেমন : গ্যাসের ওষুধ। এটি ক্ষতির কারণ হতে পারে কী?
উত্তর : আমাদের দেশে একটি সমস্যা হলো, একটু হাঁটুব্যথা, ডাইক্লোফেনাইল দেন ভাই, আমি খেয়ে নিলাম। আপনি প্রতি সপ্তাহে যদি ব্যথার ওষুধ খেতে থাকেন, আপনার কিডনির কিন্তু ক্ষতি হতে থাকল। তেমনি গ্যাসের ওষুধ ওমিপ্রাজল গ্রুপের। এগুলো আগে বলা হতো, ঠিক আছে। তবে এখন বলা হয়, কারোই দুই থেকে তিন মাসের বেশি একটানা খাওয়া উচিত নয়। আমাদের দেশের ১৬ কোটি মানুষের ১২ কোটি মানুষই কম-বেশি এগুলো খেয়ে যাচ্ছে। এগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিডনির ক্ষতি হতে পারে। হাড়ের ক্ষতি হতে পারে। মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। এগুলো আগে বলা ছিল না। এখন এগুলোর ওপর জোর দিতে হবে।
প্রশ্ন : এরপরও আসলে বিষয়টি হচ্ছে। আপনি একটু বলুন, এখানে ভোক্তা হিসেবে রোগীর কী ভূমিকা রয়েছে, যারা ওষুধ বিক্রি করছে, তাদের কী ভূমিকা রয়েছে এবং রাষ্ট্রের কী ভূমিকা রয়েছে?
উত্তর : এখানে আসলে আমাদের সবারই ভূমিকা রয়েছে। রোগী বা ভোক্তা সে কী করবে। আমি চিকিৎসক হিসেবে, আমি প্রশাসন, আমি ফার্মাসিস্ট হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব ছিল, আমি করিনি। রোগীর জানার দায়িত্ব রয়েছে, সে পয়সা দিয়ে ওষুধটি কিনেছে। পশ্চিমা বিশ্বে যেটি করা হয়, প্রতিটি ওষুধের সঙ্গে একটি পেমপ্লেট প্রিন্ট করে দেওয়া হয়। এটি খেলে কী হবে, না খেলে কী হবে, কতদিন খেতে হবে, একদম পরিষ্কারভাবে বলা হয়। রোগী পড়ুক বা না পড়ুক তার সামনে তো কাগজটি দেওয়া হলো। আবার আমি চিকিৎসক হিসেবে যখন তাকে ওষুধ দেব, প্রাথমিক কিছু বিষয় বলে দেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছে, তাদের দায়িত্ব হলো, চিকিৎসক তাকে ঠিকঠাক মতো সব দিয়েছে কি না রোগীকে জিজ্ঞাসা করবে। তারা ফোনের মাধ্যমে জানে। আর ফার্মাসিস্টের কাছ থেকে ওষুধ নেওয়ার সময় রোগী সিগনেচার করে ওষুধ নিবে। বলবে, আমাকে সবকিছু বলে দেওয়া হয়েছে। এটি ব্যবস্থাপনা করতে হবে ফার্মাসিস্টকে। প্রশাসনে যারা রয়েছে তারা সেটি খেয়াল করল, আমরাও সেটি দিয়ে দিলাম।
এখন আসুন রোগীর ক্ষেত্রে। জ্বী, আমাদের দায়িত্ব না হয় আমরা দিয়ে দিলাম, আপনাকে ছোটবেলা থেকে মাইন্ডসেট করতে হবে আপনি মুখে কী দিচ্ছেন না দিচ্ছেন সেটির বিষয়ে জানুন। এখন ইন্টানেটের যুগ। আপনি ইন্টারনেটে সার্চ করুন। একটি ওষুধ খাচ্ছেন আপনি অ্যামলোডিপিন। সার্চ করুন, অ্যামলোডিপিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। সম্পূর্ণ চলে আসবে। আপনি চিন্তা করুন। পরে যখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন, তাকে বলুন, আমি দেখলাম ১০টি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। আমার কী করা উচিত তুমি বল। চিকিৎসক এ ১০টি থেকে আপনাকে হয়তো তিনটির বিষয়ে সতর্ক করবে। তিনটি নিয়ে আমি চিন্তিত। বাকিগুলো নিয়ে কারো চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই।
প্রশ্ন : কিছু কিছু অসুখতো রয়েছে যেগুলোতে যদি ব্যায়াম করি, তাহলে ওষুধকে দূরে রাখা যায়। সে ক্ষেত্রে ব্যায়ামের গুরুত্ব কতখানি?
উত্তর : একদম বাস্তব উদাহরণ আমি আপনার সামনে। ১০ বছর আগে আমি যখন প্র্যাকটিস করি, আমি ভাবলাম, সারা বছর তো সবার ব্লাড প্রেশার চেক করলাম, আমার নিজেরটাই করা হয়নি। ব্লাড প্রেশার কাফ লাগিয়ে দেখি, স্বাভাবিক রক্তচাপ ১৩০/৮০ এর নিচে থাকার কথা। আমার নিজেরটাই ছিল ১৫৫/ ১০৫। এটা স্টেজ থ্রি হাইপার টেনশন। আমি এটি জানি না। কী করব বলুন? এত মানুষের সেবা করলাম, আমার সেবাটা কে করবে। এরপর থেকে আমি ডায়েট ও ব্যায়াম শুরু করলাম ঠিক সেভাবে যেভাবে আমি চাচ্ছিলাম। এখন আমার ব্লাড প্রেশার ১১০/ ৭৫। তাই সবাই পারবেন আপনারা।
প্রশ্ন : ভারসাম্যপূর্ণ ডায়েট তো রোগ প্রতিরোধের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
উত্তর : খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে এক নম্বর শর্ত। আমি আবারও বলছি, আমি নিজে উদাহরণ এ বিষয়ে। আমার অনেক কোলেস্টেরল হাই। প্রায় ১০ বছর চেষ্টা করেছি, কোলেস্টেরলকে ওষুধ দিয়ে, ব্যায়ামের মাধ্যমে কমানো যায় কি না। আমি দেখলাম, কোলেস্টেরলের ওষুধ যখনই আমি খেতে যাই জ্বর জ্বর ভাব লাগে, পেশির ব্যথা হয়। কিন্তু এর থেকে তো ওঠে আসতে হবে। আমি জানি, এভাবে যদি কোলেস্টেরল এত বেশি থাকে, আমি সামনে হার্ট অ্যাটাকে যাব। আমি আমার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ফেললাম। চার মাসে আমার কোলেস্টেরল কমে এসেছে।