গ্যাসের শহরে গ্যাস সংকট
বাড়িতে গ্যাসের সংযোগ আছে। রান্নাঘরে চুলাও আছে। তবে সেই চুলা জ্বলে না। কারণ, গ্যাস আসে না।
এই দৃশ্য দেশের কোনো দুর্গম এলাকার নয়। দৃশ্যটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের। অথচ এই জেলায় রয়েছে ৩৮টি গ্যাসকূপ। দেশের মোট গ্যাসের ৩৪ ভাগ সরবরাহ করা হয় এখান থেকেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দাতিয়ারা, পুনিয়াউটসহ বিভিন্ন এলাকায় কয়েক মাস ধরে চলছে গ্যাসের জন্য হাহাকার। দিনে তো বটেই, এমনকি রাতেও গ্যাসের দেখা পাওয়া যায় না। যাঁদের পক্ষে বিকল্প ব্যবস্থায় রান্না করা সম্ভব, তাঁরা হয়তো করছেন। কিন্তু অনেক পরিবারকেই রান্না করতে না পেরে প্রায় দিনই অভুক্ত থাকতে হচ্ছে।
এসব এলাকায় সকাল ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে গ্যাস চলে যায়, আসে রাতে। অর্থাৎ পুরো দিনের রান্নার জন্য এলাকাবাসীকে অপেক্ষা করতে হয় গভীর রাত বা ভোরের জন্য। সারা দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকেন গৃহিণীরা।
গ্যাসের শহরে গ্যাস না থাকা প্রসঙ্গে গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেছেন, সংকট গ্যাসের নয়। সমস্যা পাইপের। যে পাইপের মাধ্যমে এই এলাকায় গ্যাস টানা হয়েছে, তা বেশ সরু। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু সরু পাইপ আর মোটা হয়নি। তাই এখন দেখা দিয়েছে এই গ্যাস সংকট।
কিন্তু গ্রাহকদের অভিযোগ, এ সংকট নিরসনেও কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। মাসের পর মাস এ অবস্থা ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে গ্রাহকদের মধ্যে।
প্রায় চার মাস আগে শহরের দাতিয়ারা মহল্লার অর্ধশত গ্রাহক বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ বরাবর গ্যাস সংকট নিরসন করার দাবিতে একটি আবেদন করেন। এতে বলা হয়, তাঁদের এলাকায় দিনের বেলায় নিয়মিত সাত-আট ঘণ্টা একেবারেই গ্যাস থাকে না। বর্তমানে সংকট চরমে উঠেছে। গড়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা গ্যাস পান ওই সব এলাকার মানুষ। সারা দিনই গ্যাস থাকে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রায় ২২টি গ্যাসকূপ রয়েছে। এখানকার গ্যাস উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত যাচ্ছে জানিয়ে আবেদনপত্রে এলাকাবাসী জানান, তাঁদের দুর্ভাগ্য যে তাঁরা গ্যাস পাচ্ছেন না।
দাতিয়ারার বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নবজাগরণীর নির্বাহী পরিচালক তহুরা বেগম এনটিভি অনলাইনকে জানান গ্যাস না থাকার সীমাহীন সমস্যার কথা। সকালে রান্নাবান্না হয় না বলে শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হয়। যাঁরা বাড়িতে থাকেন, তাঁদেরও দুপুরের খাবার খেতে খেতে রাত হয়ে যায়। রান্নার সব আয়োজন শেষ করেও বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর রাতে যখন গ্যাস আসে, তখনো চুলা জ্বলে মিটমিট করে।
আরেক ভুক্তভোগী গ্রাহক মো. কাজল মিয়া বলেন, ‘আমরার গ্যাস যায় সারা দেশে। আর আমরাই গ্যাস ভোগ করতে পারি না। কত বড় দুর্ভাগ্য।’ তিনি জানান, তাঁদের এলাকার গ্যাসের সমস্যা নিরসনে দরখাস্ত দেওয়ার পর এলাকার লোকজন দলবেঁধে কয়েকবার অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের একটি সূত্র জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিদিন গড়ে ৮২৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়। গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে ৩৮টি কূপ থেকে এই গ্যাস উত্তোলিত হয়, যা দেশে উৎপাদিত গ্যাসের শতকরা ৩৪ ভাগ।
বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি সূত্র জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রায় ২০ হাজার গ্রাহক গ্যাস সুবিধা পাচ্ছেন।
বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের উপমহাব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এটি গ্যাস সংকটের ব্যাপার নয়। ওই এলাকার লাইনে অনেক সমস্যা আছে। প্রথমে এক ইঞ্চি লাইন দিয়ে গ্যাস টানা হয়। পরে চাহিদা কিছুটা বাড়লে তা ছিদ্র করে করে আবার দুই ইঞ্চি করা হয়। এরপর থ্রি/ফোর পাইপ দিয়ে গ্যাস নেওয়া হয়। মোটকথা, ছোট লাইন থেকে অনেক সংযোগ নেওয়া হয়েছে। আগে গ্রাহক ছিল হয়তো ৩০/৩৫ জন। আর এখন কয়েকশ। বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে। কিন্তু লাইন রয়েছে আগেরটাই।’
এ সমস্যা নিরসন করতে হলে পুরো লাইন তুলে নতুন করে পাইপ বসাতে হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। নতুন করে পাইপ বসানো অনেক খরচের ব্যাপার এবং এতে সময়ও অনেক বেশি লাগবে বলে জানান মাহবুবুর রহমান।