ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে যেসব সমস্যা হয়
আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি, ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস। ডায়াবেটিস নির্মূল করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অনেক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩১১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমুদ্দিন। বর্তমানে তিনি ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেমের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : আজ ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস। দিবসটি সামনে রেখে আপনাদের কর্মসূচি কী?
উত্তর : আমরা সবাই জানি অধ্যাপক ইব্রাহিমের নাম। উনি একজন পথিকৃৎ ছিলেন। উনার লক্ষ্য অনেক বড় ছিল। ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উনি প্রথম বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। কিছু চিকিৎসক, কিছু সমাজকর্মী এবং বড় বড় ফিলানথ্রোপিস্টকে নিয়ে তিনি সেগুনবাগিচার ৩৮০ স্কয়ার ফুটের একটি টিনশেড জায়গায় এটি শুরু করেন। সেটা আজ এত বড় হয়েছে। ১০২টি স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে সারা দেশে ডায়াবেটিস সমিতির নামে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি আজকের দিন ছাড়াও ডায়াবেটিস সেবা দিবস পালন করে ইব্রাহিম সাহেবের মৃত্যু দিবসে।urgentPhoto
প্রশ্ন : আমরা যতদূর জানি, আজ ডায়াবেটিস সমিতির ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সেটিও কি আপনারা এই কর্মসূচির মধ্যে রাখছেন। এ বিষয়ে বলুন।
উত্তর : আমরা তো এ রকম অনেক দিবস পালন করি। তার মধ্যে প্রধান হলো সচেতনতা দিবস, সেবা দিবস আর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস (১৪ নভেম্বর)। এগুলোতে প্রায় একই রকম অনুষ্ঠান থাকে। প্রধান অনুষ্ঠান থাকে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির বারডেম শাখার অডিটোরিয়াম এবং আরো যে বড় সমিতি রয়েছে, সেগুলোর অডিটরিয়ামগুলোতে আলোচনা সভা। এতে কিছু কিছু জায়গায় পুরোনো ডায়াবেটিস রোগীদের ডাকা হয়, তাঁদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব হয়। আর হয় ফ্রি ডায়াবেটিস নির্ণয় এবং ডায়াবেটিসের পরামর্শ দেওয়া হয়। এর বাইরে র্যালি হয়।
আসলে ডায়াবেটিস তো সারা জীবনের অসুখ। বাংলাদেশে প্রায় ১০ শতাংশ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। মানে এক কোটি ৬০ লাখ লোক। আমাদের বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির বারডেম শাখা আছে। আরো শাখা আছে। সারা দেশে অনেক শাখা আছে। সব মিলিয়ে ২৭ বা ২৮ লাখ ডায়াবেটিস রোগী নিবন্ধিত এসব জায়গায়। প্রফেসর ইব্রাহিম সাহেবকে ধন্যবাদ। উনি এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে আমরা এতদূর এসেছি।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে কমবেশি সব লোকই এখন ডায়াবেটিস সম্বন্ধে জানে। তবে সমস্যা হলো সচেতনতার অভাব। প্রতিরোধের জন্য করণীয় কম হয়। এ বিষয়ে বলুন?
উত্তর : বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির তিনটি জিনিস রয়েছে। একটি হলো এডুকেশন (শিক্ষা), অ্যাওয়ারনেস (সচেতনতা), আরেকটি প্রিভেনশন (প্রতিরোধ)। সচেতনতার মধ্যে এ তিনটি বিষয় আছে।
প্রশ্ন : আমরা যদি এডুকেশন (শিক্ষা) ধরি, তবে কোন কোন বিষয় ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে জানা উচিত?
উত্তর : অনেকে মনে করেন, বারবার প্রস্রাব হওয়া মানে ডায়াবেটিস হয়ে গেল। এটা মনে করা ভালো। তবে অন্য অসুখের জন্যও এটা হতে পারে। এটি প্রতিরোধ করতে হবে। বংশের ধারা থাকলে ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে বিষয়টি সব ভাবে ঠিক না। বংশে থাকলে ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে হবেই যে এমন কোনো কথা নেই। হয়তো কারো ডায়াবেটিস আছে, তার চারটি বাচ্চা, চারজনেরই ডায়াবেটিস থাকবে তা ঠিক নয়। তবে তাদের ঝুঁকি বেশি থাকে।
তবে কতগুলো জিনিস আমরা জেনেও জানতে চাই না। যেমন : কারো যদি ওজনাধিক্য থাকে, তার ওজন যদি বেশি থাকে, তার তো ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অনেক, ৬০ শতাংশ বেশি থাকে। একটি লোক যদি ধূমপান করে, তার ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। একজন লোক যদি সেডেন্টারি কর্মী হয়, যেমন ধরেন, ব্যাংকে কাজ করেন বা সব সময় কম্পিউটারের সামনে বসে থাকেন। ডায়াবেটিস রোগের এক-চতুর্থাংশ কারণ হলো, সেডেন্টারি জীবনযাপন। এই জিনিসগুলো কিন্তু সচেতনতার মধ্যে পড়ে। সারা দিনের কাজের মধ্যে যদি আপনি ভাগ করে নিয়ে কিছু ব্যায়াম করেন, তাহলে তো সমস্যা নেই।
উচ্চতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজন থাকতে হয়। রিকশাচালকের এক রকম ক্যালরি লাগে, চিকিৎসকের এক রকম ক্যালরি লাগে বা একজন ব্যাংকারের এক রকম ক্যালরি লাগে। সে অনুসারে সে যদি ক্যালরি মেনে খেতে পারে তাহলে তো হয়, এই বিষয়গুলোতে সচেতন হতে হবে। আবার ধরেন ডায়াবেটিস হয়ে গেছে, সে হয়তো সব খাওয়া বাদ দিয়ে দিল। সেটিও কিন্তু আবার ঠিক নয়।
প্রশ্ন : অনেকে আছেন, যাঁরা ভাবেন ডায়াবেটিস তো হয়েই গেছে। কমাতেও পারছি না। তখন হাল ছেড়ে দেন। সবকিছুই খেতে থাকেন। এ বিষয়ে বলুন?
উত্তর : এই বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল। ডায়াবেটিস নির্মূল করা যায় না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর নিয়ন্ত্রণ তো করতেই হবে। একজন লোক যদি নিয়মানুবর্তি হয় তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবেই। না থাকার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির একটি বই রয়েছে। কোনো ডায়াবেটিস রোগী যদি এই বইটি পড়ে, অবশ্যই সে ডায়াবেটিস সম্বন্ধে অনেক জানবে। অনেক লোকের চেয়ে ভালো জানবে। প্রথম আমরা পরামর্শ হলো, সবাই রেজিস্ট্রেশন করুন এবং ডায়াবেটিস সমিতির বইটি পড়ুন।
আরেকটি হলো, আমরা তো জানি ডায়াবেটিসের তিনটি মূল জিনিস। একটি হলো এডুকেশন, ডায়াবেটিস সম্বন্ধে জানতে হবে। দুই নম্বর হলো জীবনযাপন পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে হবে। এর মানে আপনার ওজন বেশি থাকলে ওজন কমাতে হবে। খাওয়া ও ব্যায়াম দিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। প্রতিদিন যদি আপনি ৪৫ মিনিট জিমে অথবা পার্কে ব্যায়াম করেন, তাহলে তো ভালো। আপনি যদি নিয়মিত হাঁটেন, নিয়মিত ব্যায়াম করেন, আপনার ওজন কমবেই। ওজন না কমার কোনো কারণ নেই। আর খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টিও সহজ। আপনি সবই খাবেন, তবে মিষ্টি খাবেন না। আর খাওয়াটা এমনভাবে খাবেন, যেন ওজন না বাড়ে, সহজ হিসাব।
প্রশ্ন : আবার যাঁরা বেশি সচেতন হয়ে সব খাবার ছেড়ে দিচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কী পরামর্শ?
উত্তর : দেখা গেল, আপনি এক বছরে ১৩ কেজি ওজন কমিয়ে ফেললেন। এটা তো আদর্শ নয়, এটা হতে পারে না। প্রত্যেকের একটি আদর্শ ওজন থাকে কাজ অনুসারে, বয়স অনুসারে সেই ওজন আপনি আনবেন। একদিনে আনতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। দুই বছরে কমান, তিন বছরে কমান। মূল কথা হলো, আপনাকে সচেতন হতে হবে। তবে মানব চরিত্র কিন্তু একটু ঝামেলার। সেই চরিত্রে হাত দিতে হবে।
প্রশ্ন : অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কী কী?
উত্তর : রক্তে সুগার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রয়েছে। এর মানে ডায়াবেটিস আছে। আপনার কোনো সমস্যা নেই। তবে আপনার যখন জটিলতা তৈরি হবে, তখন আপনি বুঝতে পারবেন ডায়াবেটিস আসলে একটি রোগ। জটিলতাগুলো আমরা সাধারণত দুভাবে বলি। একটি হলো মাইক্রোভাসকুলার, আরেকটি ম্যাক্রোভাসকুলার। মাইক্রোভাসকুলার মানে চোখের রেটিনায় সমস্যা। নার্ভের সমস্যা ও কিডনির সমস্যা।
আর ম্যাক্রোভাসকুলার মানে রক্তনালির সমস্যা। পায়ে গ্যাংরিন হয়ে যায়, হার্ট অ্যাটাক হয়, মস্তিষ্কে অ্যাটাক হয়ে স্ট্রোক হয়, এগুলোই ম্যাক্রোভাসকুলার জটিলতা।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে এখন পর্যন্ত প্রমাণিত যে সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব। একটি লোকের যদি কিডনিতে অসুখ না হয়, তাহলে তো তার কোনো সমস্যা নেই। যদি হার্ট অ্যাটাক না হয়, তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। এর পরও কথা রয়েছে। একজন ডায়াবেটিস রোগীর সবার যে কিডনি রোগ হবে, তা কিন্তু নয়। ৩০ ভাগ লোকের কিডনির রোগ হয়। তাদের এক ভাগ লোকের ডায়ালাইসিস লাগে। প্রতিদিন ৪৫ মিনিট বা আধা ঘণ্টা হাঁটা তো মানুষের পক্ষে কঠিন নয়। সবচেয়ে বেশি দরকার আসলে সচেতনতা।