টাম্পাকোয় এখনো ধোঁয়া
গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে টাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানার ধ্বংসস্তূপের বিভিন্ন স্থান থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। দুর্ঘটনা পর ষষ্ঠ দিনের মতো আজ উদ্ধারকাজ চলছে। গত সোমবার থেকে উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছেন সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা।
সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার চেয়ে এই কারখানার ধ্বংসাবশেষ অপসারণের পুরো কাজ শেষ করতে বেশি সময় লাগবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ওই কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে। এঁদের মধ্যে সাতজনের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন ১০ জন।
এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের তিনি জানান, এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুত তাঁদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের নগদ ১৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আর হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি থাকা আহতদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
টঙ্গী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার জানান, গত শনিবার ভোরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর এখন পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। আজ বিকেল পর্যন্ত কারখানার বিভিন্ন স্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছেন। ভয়াবহ এ ঘটনায় ওই কারখানার বিশাল ভবনের অধিকাংশই ধসে পড়ে বিশাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ধসে পড়ার পর পাঁচতলা ভবনের অবশিষ্টাংশেও ফাটল দেখা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে গোটা ভবন। এ ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হওয়া ছাড়াও আহত হন অর্ধশতাধিক। কারখানার ধ্বংসস্তূপের ভেতর আরো লাশ বা জীবিত অবস্থায় কেউ আটকা থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন নিখোঁজদের স্বজন ও স্থানীয়রা।
এই পরিস্থিতিতে গত সোমবার সকালে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে একটি দল বুলডোজারসহ ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে টাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় উদ্ধারকাজ শুরু করে।
আজ বিকেলে কারখানাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, তাঁরা দুই দিক থেকে কারখানা ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করছেন।
তবে ঘটনাস্থলে রাসায়নিকভর্তি একাধিক ড্রাম থাকায় বেশ সতর্কতার সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সেনাসদস্যরা আজ ধ্বংসাবশেষ থেকে খাট, চেয়ার, টেবিল, পাতিল, লেপ-তোষক, বইসহ বিভিন্ন মালামাল উদ্ধার করেছেন। উদ্ধারকাজে তাদের সহায়তা করছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী।
এদিকে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম জানান, গত সোমবার সেনাসদস্যরা কারখানার পূর্বপাশে রাস্তার ওপর থেকে কারখানা ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করে দুজনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। একই দিন সকাল ৭টার দিকে ভবনের তৃতীয় তলার ধ্বংসাবশেষ থেকে আরো দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর নর্দান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. মনোয়ার হোসাইন (৪০) নামের এক ব্যক্তি মারা যান।
হাসপাতালের আইসিইউর আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. নাফিউল ইসলাম জানান, মনোয়ারের শরীরের প্রায় ২০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের কারণে ফুসফুস ও খাদ্যনালি পুড়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি বুকে ও মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল। ওই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত মনোয়ার হোসাইনকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে সেখানে আইসিইউতে জায়গা না থাকায় নর্দান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
মনোয়ারকে নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে। দুর্ঘটনার পর থেকে ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে তালিকা পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। পরিচয় পাওয়া লাশগুলো এরই মধ্যে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে যে সাতটি লাশের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি, তাদের পরিচয় শনাক্তের জন্য সেগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা রয়েছে।
এদিকে, দুর্ঘটনায় নিহত জুয়েলের বাবা আবদুল কাদের বাদী হয়ে টঙ্গী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় কারখানার মালিক মকবুল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী শেফালী পারভীনসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির আহমেদ, মহাব্যবস্থাপক সফিকুর রহমান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মনির হোসেন, ব্যবস্থাপক (সার্বিক) সমীর আহমেদ, ব্যবস্থাপক হানিফ ও উপসহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন। এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ আনা হয়েছে, তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে ঘটনার পর থেকে মামলার আসামিরা সবাই পলাতক থাকায় এখন পর্যন্ত কাউকেই গ্রেপ্তার করা যায়নি।