দৃষ্টিপাত
ঈদে আমরা যাঁরা মিডিয়ার মানুষ
বাইরের লোকের কাছে আমরা মিডিয়ার মানুষ, সেলিব্রেটি। মিডিয়া মানেই লোকের কাছে গ্ল্যামার, চকচকে চেহারা, লাইট-ক্যামেরা। লোকে আমাদের সাক্ষাৎকার দেখে, লেখা পড়ে; স্ক্রিনে কথা বা ছবি দেখে আকর্ষণ বোধ করে অনেকে। কিন্তু এই যে সেলিব্রেটি, মিডিয়ার মানুষেরও ব্যক্তিগত জীবন থাকে, সেখানে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির টানাপড়েন থাকে, সেটি হয়তো কেউ দেখে না। আমরাও দেখাতে চাই না, রাখি নিজের ভেতর।
মানুষ টেলিভিশন দেখে, খবরের কাগজ পড়ে, অনলাইন পড়ে, রেডিও শোনে ঈদের দিনেও, উৎসবের দিনেও। যে মানুষগুলো অন্যের বিনোদন বা তথ্যের চাহিদা মেটান, তাঁদের বিশেষ দিন আছে কি নেই, তা হয়তো ভাবেন না অনেকেই। যে ছেলেটি শোলাকিয়া থেকে পিটিসি দেয়, লাইভ করতে তাকে কাকভোরে উঠে রেডি হয়ে ছুটতে হয় অফিসে। ক্যামেরাপারসন আর গাড়ি সঙ্গে নিয়ে চলে যেতে হয় সেই কিশোরগঞ্জ। দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত। তার নিজের হয়তো ঈদের জামাত পড়া হয়ে ওঠে না। অথচ ঈদের জামাত সবার কাছেই কাঙ্ক্ষিত, তার নিজের কাছেও। কিন্তু দায়িত্ব, অন্যের সেবা, চাকরি তাকে ব্যক্তিগত চাওয়া পূরণের চেয়ে মানুষের কথা ভাবায় অনেক বেশি।
এখন তো অনলাইনের যুগ। অনলাইন সব সময়ই লাইভ। যেখানে ঘটনা, যখন ঘটনা তখনই সংবাদ। ফলে সংবাদকর্মীকে প্রস্তুত ও সতর্ক থাকতে হয় সারাক্ষণ। এই ঈদে এমন হাজারো সংবাদকর্মী রয়েছেন, যাঁরা ছুটিতে কাজ করছেন। ঈদের দিনটিতেও ছুটছেন খবরের পেছনে, সংবাদের পেছনে। মিডিয়াকর্মীদের এটাই জীবন। এই চ্যালেঞ্জটা নেবেন বলেই তো মিডিয়াকর্মীরা মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
শুরুর দিকে অভ্যস্ত ছিলাম না। মন খারাপ লাগত। মনে হতো, ঈদের দিনে অ্যাসাইনমেন্ট, এ কেমন কথা? মানতে পারছিলাম না কিছুতেই। বন্ধু-স্বজন সবাই বেড়াবে, ঘুরবে আর আমি অ্যাসাইনমেন্টে ব্যস্ত থাকব, তা কী করে হয়! কাজ মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। সম্মান দেয়, সম্মানিত করে। ঈদের দিনে যখন অ্যাসাইনমেন্টে ব্যস্ত, তখন বন্ধুদের কাছে ও গুরুত্ব বাড়ে আমার। অন্য বন্ধুদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠি আমি।
মনে আছে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টের কথা, ঈদের দিনে। তখন সাপ্তাহিক ২০০০-এর রিপোর্টার। ২০০০ তখন দেশের জনপ্রিয়তম সাপ্তাহিক। যে সাপ্তাহিকটি অনেক দৈনিকের চেয়েও জোরাল, প্রভাবশালী ছিল। অনেকেরই হয়েতো মনে আছে টেলিভিশনে সাপ্তাহিক ২০০০-এর বিজ্ঞাপনের কথা। আফজাল হোসেনের নির্মিত বিজ্ঞাপন। দৈনিকের খুটখাট, ২০০০-এর এক ঘা-দুর্দান্ত ছিল বিজ্ঞাপনের সেই পে অব লাইন। ২৪ ঘণ্টা ছিল সাপ্তাহিক ২০০০-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় বিভাগ। স্পট রিপোর্ট। কখনো প্রতিষ্ঠানের, কখনো অনুষ্ঠানের, কখনো কোনো নির্দিষ্ট জায়গা, এমনকি সেলিব্রেটি মানুষের ২৪ ঘণ্টার হদিস খুঁজেছে ২০০০।
ঢাকার ঈদ, ঈদের দিনরাত্রি। সম্পাদক বললেন, তুমি তো ঢাকার ছেলে, ঈদের দিনের এই অ্যাসাইনমেন্টটা করো। মনে আছে, খ্যাতিমান আলোকচিত্রী ডেভিড বারিকদার, আনোয়ার মজুমদারসহ আমরা তিনজন রিপোর্টার আমি, আসাদুর রহমান আর বদরুল আলম নাবিল বেরিয়ে পড়েছিলাম খুব সকালে। আমার জোন ছিল বনানী-গুলশান-বারিধারা-নিকুঞ্জ-উত্তরা। অভিজাত এলাকা। অন্যদের অন্য জোন। ঢাকার প্রতিটি জোনের ঈদ উদযাপনের ধাঁচ ও ধরন আলাদা আলাদা।
সাপ্তাহিক কাগজ-এর সম্পাদক যখন, তখন নিজেই ঈদের দিন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম। নিজেও অ্যাসাইনমেন্ট করেছিলাম কাগজ টিমের সঙ্গে। ‘খ্যাতিমানদের ঈদ’। গতানুগতিক ঈদযাপনের বয়ান নয়। কীভাবে কাটান বিখ্যাতরা তাঁদের ঈদের দিনটি—ড. কামাল হোসেন, ড. আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সিদ্দিকা কবির, আলী যাকের, হায়াত মামুদ, হাসেম খান; এই খ্যাতিমান, কর্মকর্ম সাতজন মানুষের ঈদ উদযাপন তুলে ধরেছিলাম সচিত্র। কাগজের প্রিন্ট ও অনলাইন দুটো ভার্সনেই দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল প্রতিবেদনটি। ঈদের দিনে খ্যাতিমান আলোকিত মানুষের সঙ্গ সান্নিধ্য আজও মনে আছে, দারুণ লেগেছিল।
আরেকটা প্রোগ্রামের কথা খুব মনে পড়ে। লাইভে ছিলাম, একুশের দুপুরে, ঈদের দিনে। ঈদকে ঘিরে সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোতে থাকত নানা আয়োজন। ঈদসংখ্যা, ঈদফ্যাশন সংখ্যা, রান্নাসংখ্যা, ঈদ আনন্দসংখ্যা এমন বিশেষ সংখ্যার পরিকল্পনা ও সমন্বয়ক হিসেবে আমার সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল একুশে টেলিভিশন। কৌতূহলী দর্শকদের অনেকেই প্রশ্ন করেছিল ঈদের বিশেষ সংখ্যা নিয়ে। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
এরপর এমন অনেক অ্যাসাইনমেন্ট, টিভি প্রোগ্রাম, রেডিও লাইভে অংশ নিয়েছি ঈদের দিনে। বিশেষ দিনের অ্যাসাইনমেন্টও বিশেষই থাকে, আমার তাই মনে হয়। যাঁরা বিশেষ দিনের অ্যাসাইনমেন্ট করেন, তাঁরাও গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুরুত্বপূর্ণ মানুষকেই দেওয়া হয়। নতুন যারা মিডিয়ায় বা যারা আমার চেয়েও তরুণ বয়সে, হয়তো মন খারাপ হয় তাদের ঈদের দিনের অ্যাসাইনমেন্টে। কিন্তু সম্পাদক হওয়ার পর থেকে বুঝি, যার ওপর নির্ভর করা যায়, দায়িত্ব দেওয়া যায়, তাদেরই দেওয়া হয় বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট, বিশেষ দিনের অ্যাসাইনমেন্ট।
যোগাযোগমাধ্যমে নিয়ে লেখাপড়া করেছি। এটুকু বুঝেছি মানুষই সব, মানুষের জন্যই সব। ঈদ তো আনন্দ, খুশি, ঈদের এমন অর্থই আমি জেনে এসেছি। আমার জ্ঞান, মেধা, কাজ হোক, তা লেখা, অনুষ্ঠান, তথ্যসেবা, তা যদি মানুষের কাজে আসে, উপকারে আসে, আনন্দ দেয় তবে তার চেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে আর।
আমার কাছে সবচেয়ে বড় ঈদ, ঈদের আনন্দ তাই মানুষের উপকারে আসা, মানুষের কাজে লাগা, মানুষের সেবা।
ঈদ মোবারক, সবাইকে ভালোবাসা।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা।