অভিজিৎ হত্যা
বাকস্বাধীনতাই ছুরিকাহত
আমাদের দেশে বাকস্বাধীনতার মতো একটি অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অধিকার দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়ে আসছে। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাতপরিচয় হন্তারকদের হাতে অভিজিতের হত্যা আমাদের ক্ষয়িষ্ণু সমাজেরই করুণ চিত্র। ‘হাজার বছর ধরে বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাথে বসবাস করছে’—এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইতিহাস অন্তত তাই সাক্ষ্য দেয়। আমাদের মনোজগতের নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে একদিকে যেমন হারাতে হয়েছে অনেক অমূল্য প্রাণ, তেমনি বেড়েছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। আমাদের সরকার, বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের শিক্ষিতশ্রেণি এই পরিবর্তন ঠেকাতে পারেননি। আমাদের সামনে তাই এই মনোজাগতিক পরিবর্তনই এখন মূল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিজিৎকে কে হত্যা করেছে, সেটি এখন মূল প্রশ্ন নয়; বরং ঘটনাস্থলের ১০ গজের মধ্যে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে অভিজিৎকে হত্যা করা সম্ভব হলো—সেটিই মূল প্রশ্ন। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে বোঝা যায়, ঘটনার সময় সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছে, কেউ কেউ হয়তো বা মোবাইলে ছবি তুলেছে, যেমনটি আমরা বিশ্বজিৎ হত্যার সময় দেখেছি। সাংবাদিকরা সবাই সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও করছিলেন, কেউ তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে যাননি।
এর আগে প্রফেসর হুমায়ুন আজাদ, প্রফেসর শফিউল আলম লালন, রাজীব হায়দার কিংবা সাগর-রুনিসহ অন্যদের হত্যার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় শ্লথগতি অভিজিৎ হত্যার তদন্ত এবং বিচারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের সন্দিহান করে তোলে। অভিজিৎ হত্যার পর সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে বোঝা যায়, পুলিশসহ অনেকেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। সেসব প্রত্যক্ষদর্শীকে তদন্তের আওতায় আনা জরুরি। এ ছাড়া হত্যাকারীদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের তথ্য পর্যালোচনা করেও প্রকৃত অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুটি মোটরসাইকেল ও দুটি চাপাতি জব্দ করেছে। জব্দকৃত মোটরসাইকেল দুটি যদি প্রকৃত হত্যাকারীদের হয়ে থাকে, তবে সেগুলোর নিবন্ধন-সংক্রান্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করেও প্রকৃত হত্যাকারী পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমাদের সদিচ্ছা থাকলেই হত্যাকারী ধরার মতো উপাদান বিদ্যমান আছে।
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে যদি অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন ঘটে, সব বাধা কাটিয়ে তদন্ত সঠিক পথে এগোয়, তবে আমাদের দাবি থাকবে অভিজিৎ হত্যা মামলা যেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়। একই সঙ্গে হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দারসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করার জোর দাবি থাকবে। দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চলছে, সেটির বিপরীতে সাধারণ মানুষের মনে নৈতিক বল ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে হলেও এখন ন্যায়বিচারের একটি ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করা খুবই আবশ্যক।
অভিজিতের মৃত্যুর পর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষত, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রকাশিত ছবিগুলোতে দেখা গেছে, রক্তমাখা শরীরে অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছেন আর ঘটনাস্থলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ ও উৎসুক জনতা! কী দুর্বিষহ নির্মম চিত্র! পুলিশ হয়তো চেষ্টা করলেও অভিজিৎকে বাঁচাতে পারত না, তবে তারা খুনিদের নিরাপদে চলে যাওয়া ঠেকাতে পারত, তাদের গ্রেপ্তার করতে পারত। খুনিদের আটকাতে পুলিশের ন্যূনতম চেষ্টার কথাও শোনা যায়নি।
এই হত্যার সঙ্গে কেউ কেউ আবার মাহমুদুর রহমান মান্নার ফাঁসকৃত ফোনালাপের বক্তব্যের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করছেন। যাঁরা এসব মন্তব্য করছেন, তাঁরা যদি সাধারণ নাগরিকদের তাঁদের বক্তব্যে বিশ্বাস করাতে চান, তাহলে তাঁদের এটাও স্বীকার করতে হবে যে সাধারণ নাগরিকের জানমাল রক্ষা করার মূল দায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি জানত যে মান্নার বক্তব্যের সূত্রানুযায়ী বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলন চাঙ্গা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কাউকে হত্যা করা হবে, তাহলে সে ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার প্রয়োজনে সরকারেরই দায়িত্ব ছিল অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা করা। এ বক্তব্যের বিপরীতে ভিন্ন রকম দাবিও উঠেছে, যাতে সন্দেহের তীর ‘মান্না-সূত্র’ সংযোগকারীদের বিরুদ্ধেই যায়।
আমাদের দেশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা দেখি, ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বন্যা বয়ে যায়। এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধের তদন্ত ও প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষও ক্ষমতাসীনদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সত্যতা খুঁজে পায়। এর ফলে প্রতিনিয়ত সত্যিকারের বিচার পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে। এই পক্ষপাতমূলক আচরণ এখন আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। অভিজিৎ হত্যা তদন্তে যদি পক্ষপাতিত্বের একই ধারাবাহিকতা চলে, তবে তাঁর বিচার পাওয়ার কোনো আশা নেই বলা যায়।
অভিজিতের হত্যার পর ব্লগারদের লেখার এখতিয়ার নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। তাঁরা কী লিখবেন, কতটুকু লিখবেন, সেখানে কোনো বিধিবিধান আছে কি না বা থাকা উচিত কি না—এসব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষ বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। ব্লগ হোক কিংবা অন্য কোনো মাধ্যম, একজন লেখক আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চারটি স্বীকৃত বিষয়, যেমন—শিশু পর্নোগ্রাফিতে উৎসাহ জোগানো, গণহত্যায় উসকানি, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো এবং সন্ত্রাসে উসকানি দেওয়া—এসব বিষয়ে লেখা থেকে বিরত থাকবেন। উপরোক্ত চারটি বিষয় ছাড়া মত প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিধিনিষেধ থাকা উচিত নয়। অথচ আমাদের সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে এমন অনেক বিষয় সন্নিবেশিত আছে, যা মত প্রকাশের ক্ষেত্রে আদৌ প্রযোজ্য নয়। এসব বিধিনিষেধ ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছানুসারে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় বিধায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে।
মানবাধিকারবিষয়ক সর্বজনীন ঘোষণার ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির (International Covenant on Civil and Political Rights) ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদ এ অধিকারকে আরো ব্যাপকতা দান করেছে এবং মত প্রকাশের অধিকারের আইনগত ভিত্তি প্রদান করেছে। বাংলাদেশ এই চুক্তিতে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এর বিধিবিধান মেনে চলতে বাধ্য।
যেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, সেখানেও ধরে নেওয়া হয় অলিখিত কিছু আইন বা সংস্কৃতি থাকে, যা লেখককে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ (Self Restriction) করতে শেখায়। ২০১১ সালে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেটবিষয়ক যৌথ ঘোষণায় এ আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপরই অধিক জোর দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো ব্যক্তি যদি ব্লগে বা অন্য কোনো মাধ্যমে কোনো বিষয়ে লিখে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হন, তবে সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তাঁকে হত্যা করা কোনো যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। তা ছাড়া একটি যুক্তির বিপরীতে জিততে হলে অন্য একটি ভালো ও গ্রহণযোগ্য যুক্তিই কেবল বিকল্প হতে পারে, অন্য কিছু নয়। আমাদের ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়, সভ্যতা এগিয়ে যাবে ক্ষমতা আর প্রতিষ্ঠিত মতবাদকে প্রশ্ন করে। শিক্ষা মূলত আমাদের প্রশ্ন করার উপকরণ হাতে তুলে দেয়। আবার কিছু মানুষ থাকবে, যারা বিনা প্রশ্নে সবকিছু মেনে নেবে। সমাজ এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন মতের সম্মিলনে গড়ে ওঠে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : আইনজীবী (ব্যারিস্টার), বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, সদস্য, সাউথ এশিয়ান’স ফর হিউম্যান রাইটস।