নির্বাচন ঘিরে নতুন-তরুণদের ভাবনা
ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। চলছে ক্ষণগণনা। শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে বিদেশ, সর্বত্রই আলোচনায় এখন নির্বাচনি ইস্যু। ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। অপেক্ষার প্রহর গুণছেন প্রচরণার। এই মহাকর্মযজ্ঞকে ঘিরে বেশি আগ্রহ-উচ্ছ্বাস নতুন ভোটারদের। উৎসবের বার্তা ছড়াচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই দেশের অন্যতম প্রাচীন জেলা যশোরও। এ জেলার নতুন প্রায় আড়াই লাখ ভোটারের মধ্যে নির্বাচনকে নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নির্বাচনে প্রথম বার ভোট দিতে পারবেন বলে অনেকের আছে উচ্ছ্বাস, আবার সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ না থাকায় কেউ কেউ জানিয়েছেন উষ্মা। অনেকে আবার ভোটের পরিবেশ নিয়ে তুলে ধরেছেন শঙ্কার কথা।
জেলার ছয়টি আসনের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখা গেছে, দেশজুড়ে বেজে চলা নির্বাচনি ডামাডোলে প্রার্থীদের নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ব্যক্তি, দল, দলের কিন্তু বিদ্রোহী—এসব নিয়ে নতুন ও তরুণদের মধ্যে বইছে আলোচনার ঝড়।
সংবিধান অনুযায়ী, দেশের নাগরিকদের মধ্যে যে কারও বয়স ১৮ বছর উত্তীর্ণ হলেই ভোটার তালিকায় নাম যুক্ত করার অধিকার রয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) বছরজুড়ে এ কার্যক্রম চালায় এবং প্রতি বছরের ২ মার্চ জাতীয় ভোটার দিবসে নতুন ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। সেই ধারাবাহিকতার বাইরে এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করতে ভোটার তালিকা আরেক দফা হালনাগাদ করে তা গত ২ নভেম্বর প্রকাশ করা হয়েছে।
নতুন তালিকা অনুযায়ী, যশোরের ছয়টি আসনে মোট ভোটার ২৩ লাখ ৪০ হাজার ২২৮ জন। যার মধ্যে ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৯১২ জন ১১ পুরুষ ও ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৩১৪ জন নারী। এর মধ্যে নতুন ভোটার দুই লাখ ৪৮ হাজার ৯৪৪ জন।
নবম সংসদ নির্বাচনের পর ভোটার হওয়া অনেক তরুণের মতে, দেশে গণতন্ত্র চর্চায় ভোটারদের সম্পৃক্ত করতে ভোটের রাজনীতিতে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। তারা বলছেন, এক পক্ষীয় নির্বাচন, প্রতিপক্ষের বর্জন এবং রাজনীতির নামে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সমাজ সচেতন অনেকেই রাজনীতি ও ভোটের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আবার কেউ কেউ এক দশক আগে ভোটার হয়েও বহুবিধ শঙ্কায় ক্রমাগত ভোটকেন্দ্র বিমুখ থাকছেন।
দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে কথা হয় জেলার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার তরুণ ভোটারদের সঙ্গে। তাদের একজন মণিরামপুর উপজেলার যোগীপোল গ্রামের মেহেদী হাসান ফিরোজ। চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে মেহেদীর। তিনি বলেন, ‘আগের দুটি সংসদ নির্বাচনেও ভোট দিয়েছি, যাকে দিয়েছি তিনি জিতেছেন। এবারেও ভোট দিতে প্রার্থী আর প্রতীক ঠিক করা হয়ে গেছে।’ এই ব্যাংকার বলেন, ‘একটা দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তার মানে এই নয় যে অন্যরা বসে থাকবে। বড় দুই দলের একটা নির্বাচনে না এলে অন্যটা এমনিতেই ক্ষমতায় চলে যাবে। এক্ষেত্রে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। জাতির সামনে তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পারেনি।’
সদ্য এইচএসসি পাস করা জেলার সীমান্তবর্তী চৌগাছা উপজেলার কলেজ পড়ুয়া দুই বন্ধু শাহরিয়ার ও নাবিলের ভোটার তালিকায় নাম উঠেছে গত বছর। নাবিল বলেন, ‘আমি উন্নয়ন আর অগ্রগতির পক্ষে। সে বিবেচনাতেই ভোট দেব। প্রার্থী কে সেটা আমার কাছে বড় বিষয় নয়।’ তার বন্ধু শাহরিয়ারের কথা আরও সোজা। তিনি বলেন, ‘আমি পদ্মা সেতুর পক্ষে। জেলায় জেলায় আধুনিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। যারা যশোরে সফটওয়ার টেকনোলজি পার্ক করেছে, মরে যাওয়া ভৈরব আর কপোতাক্ষ নদ খনন করেছে, তাদের ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।’
যদিও ভোট নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দহকুলা গ্রামের দিলরুবা পারভীন বিথীর। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় সেসব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি। বিথী বলেন, ‘২০১৪ সালে জীবনে প্রথম নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে কেন্দ্রে পৌঁছাতেই ভোট দেওয়া হয়ে গেছে বলে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ভোটে বাড়ি থেকে বেরই হতে পারিনি।’ কারণ, জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ করেন, ‘ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ ছিল।’
চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি গ্রামের বাসিন্দা হাসফিকুর রহমানের বয়স ৩৩ গড়ালেও নানা কারণে ভোট দেওয়া হয়নি কোনো সংসদ নির্বাচনে। তার মতে, ভোটে প্রার্থী পছন্দের সুযোগ থাকলে অবশ্যই ভোট দিতে যাবেন।
যশোর শহরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন রবিউল ইসলাম রবি। ভোটার হওয়ার পর দুটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। রবি বলেন, ‘আগের দুবার ভোট দেওয়ার জন্য তেমন তাগিদ ছিল না। প্রার্থী বা সমর্থকরা ভোট চায়নি। তাই কাউকেই ভোট দেওয়া হয়নি। এবার কী করব, সে সিদ্ধান্ত নেয়নি এখনও।’
শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী পাঁচভুলোট গ্রামের শেখ আল আমিন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোরের বাইরে থাকায় জীবনের প্রথম ভোটটি দিতে পারেননি তিনি। তার মতে, প্রধান সব দলেরই সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করা ও ভোটে আসা উচিত। মানুষ যেন পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, প্রার্থী পছন্দের সুযোগ পায়, সহিংসতা যেন না হয়, এসব বিষয় নিশ্চিতে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কঠোরভাবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ছাত্র রাজনীতি করা আল আমিন শিক্ষা জীবনের পাঠ চুকিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে চাকরি খুঁজছেন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে হতাশার সুরে তিনি বললেন, ‘এখন টাকার মালিক বড় বড় ব্যবসায়ীরাই দলে বড় বড় পদ পাচ্ছেন। এমপি ও মন্ত্রী হচ্ছেন। ছাত্র রাজনীতি করে উঠে আসা আমার মতো মানুষেরা বাধ্য হয়েই এখন রাজনীতি বাদ দিয়ে চাকরি করছেন বা চাকরি খুঁজছেন।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) যশোরের সভাপতি শাহিন ইকবাল বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের ভোটার যারা ইতোমধ্যে দুই একবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন বা এবারই প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার যোগ্য হয়েছেন, তাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য থাকাই স্বাভাবিক। রাজনীতি করি বা না করি, প্রত্যেক মানুষের রাজনীতি সচেতন হওয়া দরকার। কিন্তু, হরেক নেতিবচকতায় নতুন প্রজন্মের মনে রাজনীতি নিয়ে খারাপ ধারণা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। এটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) যশোর জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালেহা বেগম বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করার দায় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষিত তরুণরা রাজনীতি ও ভোট এড়িয়ে চলবে। সন্ত্রাসবাদের জন্ম হবে, যা ভবিষ্যতের জন্য ভাল নাও হতে পারে।
যশোর এম এম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ড. এম হাসান সরোওয়ার্দী বলেন, ‘দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আসন্ন নির্বাচনে অবশ্যই নতুন ভোটারদের প্রভাবিত করবে। তবে, সচেতন নাগরিকরা কেবল একটি বিষয়কে সামনে রেখেই সিদ্ধান্ত নেয় না। রাষ্ট্র, সমাজ, দল, প্রতীক, নেতৃত্বসহ অরও অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভোট দেন।’
জীবনভর রাষ্ট্র বিজ্ঞানের গভীরে কাজ করা এই প্রবীণ শিক্ষক বলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের প্রত্যাশা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। যেকোনো বিবেচনায় ৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রসংশা কুড়িয়েছিল। কিন্তু, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার শেষ পর্যন্ত দেশকে সঠিক ধারায় এগিয়ে নিতে পারেনি। এরপর পর থেকে গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নের পক্ষে জনমত উঠেছে।’
নতুন ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদানে উৎসাহিত করা প্রসঙ্গে কথা হয় জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমানের সঙ্গে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন ইন্সট্রাকশন নেই। তেমন কোনো নির্দেশনা পেলে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে।