পরিবেশদূষণের প্রতিকার চাইবেন যেভাবে
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পরিবেশদূষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নদীদূষণ, নির্মাণের ফলে শব্দদূষণ, বায়ু চলাচলে বিঘ্ন ঘটানোসহ পরিবেশদূষণে আক্রান্ত হলেও ক্ষতিগ্রস্তরা জানে না, এর বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিকার চাইতে হবে? এ বিষয়ে আইন ও পৃথক আদালত থাকা সত্ত্বেও ধারণা না থাকায় প্রতিকার চাইতে পারেন না। নিচে কী কী কাজ পরিবেশদূষণের আওতায় পড়বে এবং কীভাবে প্রতিকার চাইতে হবে, সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো :
ঘটনা-১
মেহেদী হাসান একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। থাকেন রাজধানীর মগবাজার এলাকায়। তিনি যে বাসায় থাকেন, তার পাশে একটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে তিন মাস ধরে। দিন-রাত চলছে এই কাজ। ফলে প্রচুর শব্দ তৈরি হচ্ছে আশপাশে। দিনে মেহেদী হাসান সাহেব অফিসে থাকেন, তাই দিনের বেলার এই শব্দদূষণ তাঁকে সহ্য করতে হয় না। কিন্তু সন্ধ্যার পরও রাত ৩টা পর্যন্ত অনবরত কাজ চলে এই ভবনে। মেহেদী হাসান সাহেব জানেন না, রাতের বেলায়ও নির্মাণকাজ করা এবং শব্দদূষণ তৈরি আইনত অপরাধ। এবং তিনি জানেন না, কীভাবে এই অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।
ঘটনা-২
সিরাজনগর গ্রামের অধিবাসীরা পার্শ্ববর্তী হাঁড়িধোয়া নদীর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এই এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক থাকায় নদীর পানি ফুটিয়ে পান করেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও গ্রামবাসী নদীর পানিতে গোসল করেন, কাপড়চোপড় ধুয়ে থাকেন এবং এই পানিতেই গোসলের কাজ সারেন। কিন্তু কয়েক মাস ধরে হাঁড়িধোয়া পানি এসব কাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নদীর তীরঘেঁষে একটি ডাইংমিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রচুর বর্জ্য এসে পড়ছে নদীর পানিতে। পানি খাওয়া দূরের কথা, নদীর পানিতে সাঁতার কাটাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সিরাজনগর গ্রামের অধিবাসীরা এখন কী করবেন? তাঁরা কি ডাইং মিলটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবেন?
পরিবেশ আইনে বিচার
দেশের পরিবেশ-সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে প্রতিকার পাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলার বিচারের জন্য ২০১০ সালে প্রণীত হয়েছে পরিবেশ আদালত আইন। এ আইনে পরিবেশ-সংক্রান্ত যেকোনো মামলার বিচারের জন্য তিন ধরনের আদালত প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। প্রথমত. স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, দ্বিতীয়ত. পরিবেশ আদালত ও তৃতীয়ত. পরিবেশ আপিল আদালত।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও বিচার
পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০-এর ৫ ধারা অনুসারে, দেশের প্রতিটি জেলায় পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য একটি বা তার বেশি স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রয়েছে। একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এ আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর নিয়মিত অন্য কাজের পাশাপাশি পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনা করেন। প্রথমে নিকটবর্তী থানায় এজাহার দায়ের করে মামলার কার্যক্রম শুরু করতে পারেন। থানায় মামলা গ্রহণ না করলে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে হয়। সে ক্ষেত্রে এজাহার দায়ের করার পর অভিযোগটির তদন্ত করে এ আদালতের কাছে জমা দেওয়া হলে তবেই মামলার বিচার শুরু হবে। যেসব মামলার বিচারের ক্ষমতা এ আদালতের নেই, সেসব মামলা আমলে নিয়ে এ আদালত তাঁর বিচারের জন্য ঊর্ধ্বতন পরিবেশ আদালতে প্রেরণ করেন।
এ আদালতের বিচারক সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল এবং পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দিতে পারবেন। মামলা দায়েরের ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার নির্দেশনা আছে আইনের ৬ ধারায়।
পরিবেশ আদালতে বিচার
পরিবেশ আইনের ৪ ধারামতে, প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত রয়েছে। যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচারককে এ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে, যিনি তাঁর দৈনন্দিন কাজের অতিরিক্ত হিসেবে কিংবা নিবিড়ভাবে কেবল পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলার বিচার করবেন । এ আদালত দুই ধরনের মামলার বিচার করবে।
প্রথমত, স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে যেসব মামলা পরিবেশ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে সেগুলো; দ্বিতীয়ত, ক্ষতিপূরণের জন্য কোনো দেওয়ানি প্রকৃতির মামলা, যা কোনো নাগরিক সরাসরি এ আদালতে দায়ের করেছেন।
পরিবেশ আপিল আদালতে বিচার
পরিবেশ আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ পরিবেশ আপিল আদালতে তার আপত্তি উত্থাপন করে আপিল করতে পারবেন। সারা দেশে এক বা একাধিক আপিল আদালত প্রতিষ্ঠা করতে পারে সরকার। জেলা জজ বা দায়রা জজ পর্যায়ের কেউ এ আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
পরিবেশ আদালতের আইন
২০১০ সালের পরিবেশ আদালত আইনটি প্রণয়ন করার আগে ২০০০ সালের একটি পরিবেশ আদালত আইন কার্যকর ছিল। সে আইনে সরাসরি কোনো নাগরিক পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারতেন না। সংক্ষুব্ধ নাগরিক প্রথমত পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতেন। এর পর মহাপরিচালক প্রয়োজন বোধ করলে ওই বিষয়টিকে আদালতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু নতুন আইনে নাগরিককে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সরাসরি মামলা দায়েরের অধিকার দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত যেকোনো মামলা গ্রহণ করবে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। সুতরাং নাগরিকের প্রথম দায়িত্ব হলো পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয় প্রতিকারের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্বারস্থ হওয়া। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরে কোনো নাগরিক আবেদন করার পরও যদি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সরাসরি আদালতের সহায়তা চাইতে পারেন। আদালত তাঁর আবেদন গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে মামলাটি বিচারের জন্য আমলে নিতে কিংবা পরিদর্শক তদন্ত করার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
আদালতে বিচার হয় যেভাবে
পরিবেশ আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি—দুই ধরনের মামলা করা যায়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫সহ অন্য বিভিন্ন পরিবেশ আইনে পরিবেশ-সংক্রান্ত অপরাধের সংজ্ঞা ও সাজার বর্ণনা দেওয়া আছে। সেসব অপরাধের বিরুদ্ধে আদালতে যে মামলা করা হবে, সেগুলো হবে ফৌজদারি। আর পরিবেশের ক্ষতি করার অপরাধে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করতে পারেন। এ ধরনের মামলা হবে দেওয়ানি প্রকৃতির। ফৌজদারি প্রকৃতির মামলার বিচারে ফৌজদারি কার্যবিধি আর দেওয়ানি প্রকৃতির মামলার বিচারে দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসরণ করা হবে।
পরিবেশ আদালতের সমস্যা
আইন অনুসারে দেশের প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও বর্তমানে সাকল্যে মাত্র তিনটি পরিবেশ আদালত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে কাজ করছে। পরিবেশ আপিল আদালত রয়েছে ঢাকায় একটি। দেশের সর্বত্র পরিবেশদূষণ দারুণভাবে বৃদ্ধি পেলেও আইন প্রণয়নের পাঁচ বছর পরও জেলায় জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপিত হয়নি। যে তিনটি আদালত কাজ করছে, সেখানে তৈরি হয়েছে প্রচণ্ড মামলাজট। জনবল স্বল্পতা, পরিবেশ অধিদপ্তরের অসহযোগিতা ইত্যাদি কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন ছাড়া এখন পর্যন্ত আদালত মামলা নিতে চায় না বলে লোকজন এখানে মামলা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়া সাধারণ নাগরিকরা এখনো ঠিকমতো জানে না যে, পরিবেশদূষণের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়।