এক ইস্যুতে এত মামলা : রাজেশ চৌধুরী

Looks like you've blocked notifications!

২০১৪ সালে প্রথম সহকারী জজ হিসেবে স্বাধীনভাবে কোর্টে উঠি। সিনিয়ররা আগে থেকেই সাবধান করেছিলেন মামলার নিষ্পত্তির ব্যাপারে। কিন্তু আদালত চালাতে গিয়ে দেখি, রায় দেওয়ার মতো কোনো মামলাই নেই। এডিআর খুঁজতে গিয়ে দেখি তাও নেই। টেনশনেই পড়ে গিয়েছিলাম।

একদিন সাক্ষী নেওয়ার সময় একজন লোককে দেখে চেনা চেনা মনে হওয়ায় এজলাস থেকেই ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার তো আমার আদালতে আরো মামলা আছে। তিনি বললেন, জি স্যার। ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম, তিনি বিদেশে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী আরেকজনকে বিয়ে করেছেন। আবার তাঁর বিরুদ্ধে দেনমোহর আর খোরপোশের মামলাও করেছেন। অপরদিকে তিনি করেছেন দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা। স্ত্রীকে তিনি পাঁচ শতক সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন। সেটা বাতিল চেয়ে আবার দেওয়ানি মামলাও করেছেন।

আবার এদিকে ওই ব্যক্তি নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্বের জন্যও আদালতে আবেদন করেছেন। আদালতে এলে কত মামলা করতে হয়, তা দেখে আঁতকে উঠে বলে ফেললাম, এক ইস্যু থেকে এত মামলা!

হঠাৎ মনে হলো, এডিআরের চেষ্টাই কেন করে দেখি না। কিন্তু ভদ্রলোকের মেজাজ তখন চরমে, একে বউয়ের প্রতারণা মানতে পারছেন না, অন্যদিকে মামলার পর মামলা চালিয়েও সহজে কোনো সমাধান দেখছেন না। এর মধ্যে তিনি ফৌজদারি মামলা করার কথাও ভাবছেন, উকিলেরও নাকি তেমন পরামর্শ।

আমি বললাম, সর্বনাশ, এভাবে মামলা করতে করতে তো কবরে চলে যাবেন, বাকি থাকবে শুধু মামলাই। তাঁকে বসতে বলে বাকি মামলা শেষ করে বোঝালাম, আপসেই মিলতে পারে সমাধান। হতে পারে অর্থসাশ্রয়, সঙ্গে মিলবে দ্রুত সমাধান। ভদ্রলোক দ্বিধাগ্রস্তভাবে আমার প্রস্তাবে নিমরাজি হলেন। এজলাস থেকে নামতেই পেশকার বললেন, ‘উকিল তো স্যার বড় কড়া। আন্নের কতা হুইনত ন, হেতে মাঝেমইধ্যে আঁরারেও মাইরতে উডে।’ শুনে তো আবার চিন্তায় পড়ে গেলাম; বললাম, দেখা যাক।

আমি আইনজীবীকে পরদিন সকালে চেম্বারে আসতে বললাম। পরদিন তিনি এলেন, বারের অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ আইনজীবী তিনি। চা-পরোটা দিয়ে আপ্যায়িত করলাম, এবার তাঁর মক্কেলকে ডেকে পাঠালাম। অল্প একটু বোঝাতেই ইহকাল-পরকাল সম্বন্ধে বলতেই অ্যাডভোকেট সাহেবও রাজি। মেয়েপক্ষকে ডেকে পাঠালাম, এলেন তাঁরাও। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে এডিআর সফল। শর্তানুযায়ী, মেয়ে পেল দেনমোহর, দানপত্র দলিল হলো বাতিল, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলাও তুলে নেওয়া হলো। বিচারকাজে আমার প্রথম তৃপ্তি ছিল সেটাই। যতদিন সহকারী জজ ছিলাম এমন অনেক এডিআর করেছি, মনে হয়, লোকের আশীর্বাদও পেয়েছি। একবার তো একজন আমার থেকেও বয়সী লোক পায়ে ধরে প্রণাম করে ফেলল। একই স্টেশনে বিচারিক হাকিম হওয়ার পরেও এমন অনেকে এজলাসে এসে দাঁড়িয়ে থাকত।

আমার তৃতীয় কর্মস্থল ছিল ঢাকা জেলায় লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা হিসেবে, যেখানে অন্যতম প্রধান কাজ ছিল এডিআর করা। করেছি সম্পূর্ণ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা আর ধৈর্য নিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফলতা থাকলেও ব্যর্থতায়ও কখনও শামিল হয়েছি। কিন্তু যা করেছি, ব্যক্তিগত যোগ্যতা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়েই। এ বিষয়ে কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান কিন্তু আমার ছিল না। তাই কখনো দ্বিধান্বিত থাকতাম আমার নিজস্ব কর্মপ্রক্রিয়া নিয়েই।

সেই সংশয় কিছুটা দূর হয় ঢাকায় জাইকার আয়োজিত তিন দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় গিয়ে। এর মাঝেই সিএমএম কোর্টে বদলি। এর আগেই আমাকে জাপানে এডিআরবিষয়ক এখনকার প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়। অবশ্যই আনন্দিত ছিলাম, দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে প্রথম সফর, সঙ্গে তৃপ্তিও কাজ করছিল আদালতের মামলাজট কমানোয় পথিকৃৎ একটা দেশের বিচার ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করা এবং এডিআর বিষয়ে হাতেকলমে শেখার সুযোগ মিলায়।

অদ্ভুত এ দেশ! নিয়মানুবর্তিতা আর সময়ানুবর্তিতায় যেমন ছাড় নেই, শেখানোর ক্ষেত্রেও জুড়ি নেই। কোনো বিরক্তি নেই, থিওরিটিক্যাল বিষয়ে বোঝাচ্ছেন, ধৈর্যসহকারে প্র্যাকটিক্যাল করে দেখাচ্ছেন। শুধু নিজেরা করছেনই না, সব ট্রেইনি জজকেই তাঁরা এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করেছেন। তাই এই ডেলিগেটের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়েটার ব্যাপারে যখন একজন জেলা জজ বলেনম, this training is going succesful and she is the ultimate example of this. আমি একটুও অবাক হইনি। সত্যিই তো তাই! জাপানিরা নেতিবাচক কিছু  বলেন না। ভুল করলেন, উত্তরটা হবে—ঠিক আছে, আপনার প্রেজেন্টেশন খুব ভালো হয়েছে, তবে এদিকটা এভাবেও ভেবে দেখতে পারেন এবং এটাই বাইরের দেশে ফলো করা হয়। এতে হয় কি, কনফিডেন্স ঠিক থাকে, সঙ্গে বিকল্প ভাবার জন্য মন ও মস্তিস্কও তৈরি হয়।

এডিআরের ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক দিক নিয়ে গবেষণায় ঋদ্ধ প্রফেসর ইনাভা যখন বলেন, তোমাদের দেশে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন, তোমাদের উপায় তোমাদেরই বের করতে হবে—তখন আমি খুঁজে পাই এক সার্বভৌমের ওপর আরেক সার্বভৌমের শ্রদ্ধা। অথচ জাপান অর্থ, বিত্ত, সামরিক অস্ত্রে বহুগুণে সমৃদ্ধ।

আবার প্রফেসর ইকেদা যখন জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, তোমাদের দেশের জেন্ডার ডিসপ্যারিটি নিয়ে বাইরে থেকে কথা বলাটা তোমাদের জন্য শোভন না, তখনো উনার চিন্তা-চেতনা দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে। কর্মঘণ্টার প্রতিটা ক্ষণ জাপানিরা কাজে লাগায়। আমরা কতটা নিখুঁতভাবে তাদের শেখানো পদ্ধতি চর্চা করছি তাতে তাদের শ্যেনদৃষ্টি।

আমি একদিন অস্থিরভাবে বললাম, অনেক মামলা তো এভাবে হয় না, কিছু জায়গায় এডিআর কাজে লাগাতে পারছি না। প্রফেসর ইনাভা তখন হেসে বললেন, সব মামলাতে এডিআর হয়ও না, হলে তো কোনো দেশেই মামলা থাকত না। এরা সব শ্রেণি-পেশা মিলিয়ে একটা মেডিয়েটর শ্রেণি গড়ে তুলেছেন, যেটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমাদের জনগণের মামলা না করে আপসকেন্দ্রিক মনোভাব গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ। আসলে কাজ করতে হবে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই। আমাদের দেশে শিশুদের পিঠে তুলে দেওয়া হয় ভারী ব্যাগ। আর এরা প্রথম তিন বছর শেখায় নিয়মানুবর্তিতা, টিমওয়ার্ক, বাগান করা, পশুপাখি পালন করা ইত্যাদি।

এক বড় ভাই বলছিলেন, তোমরা জজরা বিদেশ গিয়ে কী করবা? আমার মনে হয়, বিচারকদের জন্য এমন ট্যুর, এমনকি ব্যক্তিগত ট্যুরও গুরুত্বপূর্ণ। এতে দৃষ্টি প্রসারিত ও পরিশীলিত হয়, হয় বিভিন্ন বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা; যা নিজেকে সমৃদ্ধ করে নিঃসন্দেহে।