জমি নিয়ে বিরোধ, মামলা ছাড়াই থানায় নিষ্পত্তি

Looks like you've blocked notifications!

মামলা গ্রহণ না করে বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে লালমাই উপজেলার বাকই উত্তর ইউনিয়নের জয়শ্রী গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনটি পরিবারের বিরোধ নিরসন করলেন লালমাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আইয়ুব। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিন পরিবারের সব সদস্য এবং গ্রামের গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে ওসির নিজ কক্ষে বিরোধ নিরসন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, জয়শ্রী গ্রামের যোগেন্দ্র সিংহ রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া আট একর ২২ শতক সম্পত্তির মালিক হন তিন ছেলে— মৃনাল সিংহ রায় (ব্যবসায়ী), দিলীপ সিংহ রায় (স্কুল শিক্ষক) ও স্বপন সিংহ রায় (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী)। সেই সম্পত্তি তিন ছেলের নামে ২৮ নম্বর ডিপি খতিয়ানে যথাক্রমে ৩৩৩, ৩৩৩ ও ৩৩৪ হিস্যায় লিপিবদ্ধ হয়। সেই অনুযায়ী, তিন ভাই একমত পোষণ করে মৌখিকভাবে বাড়িসহ নাল জমি সমান হিস্যায় বণ্টন করে ভোগদখল শুরু করেন। কিন্তু ১৮৯ নম্বর বিএস চূড়ান্ত খতিয়ানে ভুলবশত হিস্যা যথাক্রমে ৩০০, ৪০০ ও ৩০০ উল্লেখ করা হয়। যৌথ পরিবারে বসবাস করায় খতিয়ানে হিস্যার ভুল হলেও তাঁদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়নি। সেজন্য তাঁরা সংশোধনও করেননি। যৌথ সম্পত্তি থেকে পরিবারের প্রয়োজনে মৃনাল সিংহ রায় ও স্বপন সিংহ রায় বিভিন্ন সময়ে সম্পত্তি বিক্রি করেন। এরই মধ্যে ২০০৭ সালে দিলীপ সিংহ রায় এবং ২০০৮ সালে মৃনাল সিংহ রায় মারা যান। দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে তাঁদের সন্তানদের পাশে অভিভাবকের মতো ছায়া হয়ে দাঁড়ান স্বপন সিংহ রায়। ভাতিজারাও চাচাকে পিতৃসম্মানে অভিভাবক মেনেই নিজ নিজ পৈত্রিক ভিটায় বসবাস করে আসছেন। স্বপন সিংহ রায় কয়েক বছর পূর্বে গ্রামের নিজ মালিকানাধীন সম্পত্তিতে (বাড়ির অংশে) একটি ঘর নির্মাণ করেন। কিন্তু চাকরির কারণে কুমিল্লা শহরের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করায় নির্মিত ঘরটিতে বড় ভাই দিলীপ সিংহ রায়ের মেজ ছেলে মৃদুল সিংহ রায়কে মাসিক এক হাজার টাকা ভাড়ায় বসবাস করতে দেন। একই সময়ে বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি ভিটি তাঁর বড় ভাই শিমুল সিংহ রায়কে শর্তসাপেক্ষে চাষাবাদ করতে দেন।

আরও জানা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের আগস্টে স্বপন সিংহ রায় গ্রামের নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে চান। সে জন্য ভাতিজা মৃদুলকে ঘর ছাড়তে বলেন। মৃদুল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভাড়া পরিশোধ করে সময় চাইলে ঘরের মালিক স্বপন সিংহ রায় রাজি হন।  কিন্তু, চলতি মাসের প্রথমে মৃদুল চাচাকে জানিয়ে দেন, তিনি ঘর এবং শিমুল সিংহ রায় ভিটি ছাড়বে না। মৃদুল ও শিমুলের দাবি, বিএস খতিয়ানে হিস্যা যেভাবে আছে, সেভাবে ভাগ হতে হবে। জ্যেঠা ও চাচা যেসব সম্পত্তি বিক্রি করেছে, সেগুলো ফেরত দিতে হবে। এতে তিনটি পরিবারে বিরোধ বাড়তে থাকে। সুযোগ পেয়ে বহিরাগত কিছু লোক পরিবার তিনটির বিরোধ বাড়াতে কুপরামর্শ দেওয়া শুরু করে।

কয়েকদিন আগে ভাড়া ঘর ও ভিটি জমি উদ্ধারে আইনি সহায়তার জন্য স্বপন সিংহ রায় একটি মামলা করতে লালমাই থানায় যান। কিন্তু, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পুরো ঘটনাটি শুনে মামলা না নিয়ে বিট পুলিশিং-এর মাধ্যমে তিন পরিবারকে জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ গ্রামের গণ্যমাণ্যদের ২৬ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) বিকেল সাড়ে ৩টায় থানায় আসতে বলেন। ওসির ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংবাদকর্মী জহিরুল ইসলাম, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বার আবুল কাশেম, জয়শ্রী গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি হাজী তৈয়ব আলী, গ্রাম প্রতিনিধি মাস্টার আবু হানিফ, ডা. নারায়ণ চন্দ্র দাস, মুজিবুর রহমান, কৃষকলীগ নেতা আবুল কালাম, মৃনাল সিংহ রায়ের ছেলে লিটন সিংহ রায়, জোটন সিংহ রায়, দিলীপ সিংহ রায়ের ছেলে শিমুল সিংহ রায়, মৃদুল সিংহ রায়, পলাশ সিংহ রায়, স্বপন সিংহ রায় এবং তাঁর ছেলে শুভ্র সিংহ রায় থানায় উপস্থিত হন।

থানার সহকারি উপপরিদর্শক(এএসআই) সারওয়ার মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে ওসি জমির বিভিন্ন কাগজপত্র দেখে এবং সবার কথা শুনে জয়শ্রী গ্রামের গণ্যমান্যদের সহায়তায় বিরোধ নিরসন করে দেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মৃদুল সিংহ রায় আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত স্বপন সিংহ রায়ের ঘর এবং চলতি ফসল (টমেটো) শেষে ভিটি ফিরিয়ে দিবেন। তবে এ ক্ষেত্রে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চাচা-ভাতিজা ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে একটি ভাড়া চুক্তিনামা করে নেবেন। স্বপন সিংহ রায় নিজের মালিকানাধীন অন্য একটি খতিয়ানের নাল ২২ শতক জমি দিলীপ সিংহ রায়ের ছেলেদের ফিরিয়ে দিবেন। মৃনাল সিংহ রায়ের ছেলেরাও ৪৪ শতক জমি দিলীপ সিংহ রায়ের ছেলেদের ফিরিয়ে দেবেন। ভবিষ্যতে সময়-সুযোগ করে সার্ভেয়ার দিয়ে ভোগ দখলীয় বাড়ির সম্পত্তি পরিমাপ করে কোনো সমস্যা থাকলে ওয়ার্ড মেম্বারের উদ্যোগে নিরসন করবেন।

বিরোধ নিরসনের একপর্যায়ে ভাতিজারা চাচা স্বপন সিংহ রায়ের পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করেন। এ সময় থানার ওসির কক্ষে এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়। কোনো প্রকার মামলা, অর্থ অপচয় বা হয়রানি ছাড়াই বিরোধ নিরসন হওয়ায় তিন পরিবারের সদস্যেরা বাংলাদেশ পুলিশ তথা লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন।

দিলীপ সিংহ রায়ের বড় ছেলে শিমুল সিংহ রায় বলেন, ‘পুলিশের উদ্যোগে এত সহজভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি হবে চিন্তাও করিনি। সম্পত্তিও ফিরে পেয়েছি, চাচাকেও আপন করতে পেরেছি।’

স্বপন সিংহ রায় বলেন, ‘ভাতিজা মৃদুলের দখল থেকে ঘর ও শিমুলের কাছ থেকে ভিটি উদ্ধারের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে থানায় গেছি। কিন্তু, কোনো মামলা ছাড়াই শুধু থানার ওসি মহোদয়ের আন্তরিকতায় সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।’

এ বিষয়ে কুমিল্লার লালমাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন, ‘বিট পুলিশিং-এর মাধ্যমে পারিবারিক ছোট ছোট বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমাজে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’