নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ভাতা নিয়ে অডিট, অজানা ফলাফলে ধোঁয়াশা!
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় সব প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবিধানিক এ সংস্থাটি এখন ব্যস্ত নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে। প্রশিক্ষণার্থীদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে নির্বাচনি দায়-দায়িত্ব। সংসদ নির্বাচনের আগে আগামী প্রায় দু’মাসে মাঠপর্যায়ের সাড়ে ৯ লাখ নির্বাচনি কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেবে ইসির নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ইটিআই)। এ বাবদ এবার বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৩৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ ছিল ৬১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর উপজেলা নির্বাচনে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
ওই নির্বাচন ও পরবর্তীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও প্রশিক্ষণের নামে ওঠে অর্থ লোপাটের অভিযোগ। তা নিয়ে হয় অডিট। তবে, সেই অডিটের ফলাফল নিয়ে কেউ দিতে পারেননি কোনো তথ্য। মোটা দাগে তাই অডিট ফলাফল ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থাকায় সেটি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে বলেই ধারণা সবার। সে সময় বক্তৃতার নামে বিপুল অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয়। বক্তৃতা কিংবা প্রশিক্ষণ না দিয়ে টাকা নয়ছয়ের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় অডিট শুরু করে। ফলে, এবার প্রশিক্ষণ নিয়ে আগেই সতর্ক নির্বাচন কমিশন।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ এবং পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় আট লাখ নির্বাচনি কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণের সময় প্রশিক্ষণ না দিয়েই প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকার ভাতা লোপাটের অভিযোগ ওঠে। ফলে বিপাকে পড়ে ইসি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও ইসির নীতিমালা ছাড়া এই অর্থ খরচ করায় সৃষ্টি হয় অস্বস্তিকর পরিস্থিতির। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর যখন বক্তৃতা ভাতার নামে টাকা নেওয়া সংক্রান্ত অভিযোগগুলো আসতে থাকে তখন ইটিআই মহাপরিচালক ছিলেন মোস্তফা ফারুক। এ ঘটনার জের ধরে মোস্তফা ফারুককে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে (স্ট্যান্ড রিলিজ) বদলি করা হয়। তারপর তিনি অবসরে যান। এ অডিট সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তফা ফারুক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি এখন আর ওই সার্ভিসে নেই। ফলে, বলতে পারব না অডিটের পরে কী হয়েছিল।’
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তাই। ইটিআইয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “নির্বাচনের আগে একদিনে সারা দেশের সব উপজেলায় প্রশিক্ষণের নামে ‘কোর্স পরিচালক’ বিপুল টাকা নেন বলে অভিযোগ ওঠে। প্রতি উপজেলার বরাদ্দ থেকে তিনি পাঁচ হাজার করে টাকা নেন বলে অভিযোগ ওঠে। শুধু তিনি নন, আরও অনেকেই এভাবে টাকা নেন বলে জানা যায়। এসব অভিযোগের পরে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় অডিট শুরু করে। তখন অনেক কর্মকর্তা টাকা ফেরত দেন। এ অভিযোগ ছিল ইসির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারির ওপর। তবে, অডিটের রিপোর্ট সম্পর্কে পরে আর কিছু জানা যায়নি।” তবে নির্বাচনি প্রশিক্ষণের নামে এ ধরনের পুকুর চুরি নতুন নয়। অতীতেও কমবেশি এ ধরনের ঘটনার নজির রয়েছে।
ইটিআইয়ের বর্তমান মহাপরিচালক এস এম আসাদুজ্জামানও জানেন না, হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের ওই অডিটের পর কী হয়েছে। এনটিভি অনলাইনকে মহাপরিচালক বলেন, ‘এ অডিট বা রিপোর্ট সম্পর্কে আমি কোনো তথ্য পাইনি। আমি এই দায়িত্বে আসার পর কেউ আমাকে এ নিয়ে কিছু বলতে পারেনি। আমি যখন অন্য দপ্তরে ছিলাম, তখন কানাঘুষা শুনেছি। তবে, আমি ইটিআইয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায়ও খোঁজ নিয়েছি। শাখা থেকে আমাকে কেউ কিছু জানাতে পারেনি। এ সংক্রান্ত কোনো নথিও আমাদের কাছে নেই।’
মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘সম্ভবত অডিটটা হওয়ার পর ইসি সচিবালয়ে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় একটি প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছিল। সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে আমি আমার দায়িত্বকালীন অবস্থা সম্পর্কে বলতে পারব। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা যে ট্রেনিং করাচ্ছি এবং ভাতা দিচ্ছি, তা অর্থ মন্ত্রণালয় যেভাবে বলছে সেভাবেই দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত আর কোনো অভিযোগ নেই।’
ইটিআইয়ের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘গতবার এ ধরনের অভিযোগ ওঠার পর এ ব্যাপারে এখন সবাই সতর্ক। এবার ওই ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম। আর মূলত টাকা নয়-ছয় হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় তখন, যখন উপজেলা পর্যায়ের ট্রেনিং শুরু হয়। এখনও ওসব ট্রেনিং শুরুই হয়নি, এখন চলছে ডিসি-এসপিসহ ভিআইপি নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ।’
বক্তৃতার নামে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ যখন ওঠে তখন ইসির অতিরিক্ত সচিব ছিলেন মোখলেসুর রহমান। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, “হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে একটি অডিট করা হয়েছিল। কিন্তু, পরে তারা কী রিপোর্ট দিয়েছিল, কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল; এ ব্যাপারে কিছু জানি না।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অডিট হয়েছিল, তা জেনেছিলাম। কিন্তু, পরে কী হয়েছিল, না হয়েছিল– তা আর জানা যায়নি।’
তথ্য ঘেঁটে জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় ৯ জন ‘বিশেষ বক্তা’ ১৮ দিনে (২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্য়ন্ত) জেলা ও উপজেলার ৫২০ জায়গায় বক্তৃতা দেন। প্রতিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চারজন ‘বিশেষ বক্তা’র উপস্থিত থাকার কথা ছিল। ফলে প্রত্যেক ‘বিশেষ বক্তা’কে দিনে কমপক্ষে ১৪টি স্থানে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। যা অসম্ভব। এ সম্পর্কে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলামের কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাংলাদেশে নামগুলো হচ্ছে খুব কমন (একই রকম)। ওসব বক্তার তালিকায় ১৫ বার ছিল রফিকুল ইসলাম। এর মধ্যে ১০ জনের মতো রফিকুল ছিলেন উপজেলা নির্বাচন অফিসার। তারাও নামের নিচে শুধু ‘নিক’ (নির্বাচন কমিশন) লিখেছে। পদবী লেখেনি। আমার নাম যখন লিখেছে, তখনও নিক লিখেছে। আমার পিএস হয়তো তাড়াহুড়ো করে আমার পক্ষ থেকে সই করেছে। আমরা তো আর সই করিনি। এ প্রোবাবিলিটি (সম্ভাব্যতা) ঘটনাটিতে কাজ করতে পারে। আরেকটা যে প্রোবাবিলিটি কাজ করেছে, তা হলো, যারা টাকা বিতরণ করেছেন, তারা সই করে নিয়ে রেখেছেন। হয়তোবা পরে আমাদের ভাতা দেওয়ার চেষ্টাও ছিল তাদের। করেন নাই তা কিন্তু আমি বলব না। তবে পৌঁছাতে পারেননি।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বগুড়াতে ক্লাস নিইনি। অথচ আমার জন্য সম্মানী ভাতা এসেছে। আমি কিন্তু তা গ্রহণ করিনি। বরং, বলে দিয়েছিলাম—এটা আমার না। তারপর তারা টাকাটা চালানের মাধ্যমে ফেরত দিয়েছিলেন কি-না আমি জানি না। আবার আমাদের কাজ ছিল কিন্তু শুধু ক্লাসে গিয়ে বক্তৃতা না, মূলত যারা ট্রেনার ছিলেন তাদেরও দিক-নির্দেশনা দেওয়া। এমনও হতে পারে, টাকাটা হয়তো তারা তুলে নিয়ে আমাদের দিতে চেয়েছিলেন। আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, ট্রেনিং করাইনি এমন কোনো জায়গা থেকে আমি কখনো টাকা নিইনি। সুতরাং ঢালাও অভিযোগ সঠিক নয়।’