রম্য

রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ও পিথাগোরাসের প্রতিক্রিয়া

Looks like you've blocked notifications!

সম্প্রতি একজন টিভি রিপোর্টার এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কিছু সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করেন, সেসবের উত্তরে তারা যা বলেছেন সেই ভিডিও এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। ভিডিও দেখার পর শোক প্রকাশ করেছেন প্রশ্ন সম্পর্কিত ব্যক্তিরা। তারই কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।

রবীন্দ্রনাথের শোক প্রকাশ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ভিডিওটা দেখলাম। ভিডিও দেখে খুবই কষ্ট পেয়েছি। জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থী যখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতার নাম বলেন কাজী নজরুল ইসলাম, তখন প্রথমেই আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আসলেই কি জাতীয় সংগীত আমি লিখেছিলাম! আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেল। জাতীয় সংগীত যেন কোনটা? অনেক কষ্টেও মনে করতে পারলাম না। সারা দিন ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ভাইবার, ইমো, ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকি যে এসব সংগীত ফংগীত নিয়ে ভাবার সময় কই? আর এত কিছু মনে রাখা ব্রেইনের জন্য কষ্টকর বটে। অবশেষে গুগল করলাম। অনেকগুলো লিংক পেলাম। একটা লিংকে দেওয়া জাতীয় সংগীতের রচিয়তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আরেকটা লিংকে দেওয়া কাজী নজরুল ইসলাম। দুটি লিংকে দুটি তথ্য দেখে আমার মাথা আবার হ্যাং হয়ে গেল। ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানে আজকে রাতে আমার ভিলেজ অ্যাটাক দেওয়ার কথা ছিল, এসব ভিডিও আর লিংক ঘাঁটাঘাঁটি করে মাথা হ্যাং করায় এখন আমি অ্যাটাক দিতেও ভুলে গিয়েছি। আমার মাথা হ্যাং করিয়ে দেওয়ার জন্য জিপিএ ৫ শব্দটার জন্য আমি শোক প্রকাশ করলাম।

কাজী নজরুলের শোক প্রকাশ

আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হবো শান্ত, যেদিন জিপিএ ৫ নিয়ে লাফালাফিতে বাঙালি দেবে ক্ষান্ত!

রণসংগীত লিখেছিলাম যেন সেটা শুনে মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনুপ্রেরণা পায়। কিন্তু আজ যখন জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভিডিওতে দেখলাম রণসংগীত আমি লিখিনি লিখেছেন রবিবাবু, তখন মেজাজটা বিগড়ে গেল। আবার দেখলাম আমি নাকি জাতীয় সংগীত লিখেছি! পোলাপানদের দোষ নেই, দোষ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের! রবিবাবুর জন্য শোক প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর কিছু বলার নেই।

উল্লাসিত পিথাগোরাস

ছোটবেলায় সাহিত্যকর্ম করার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। পাশের বাসার মেয়েটাকে ভেবে ভেবে বেশ কিছু জ্বালাময়ী প্রেমের কবিতাও লিখেছিলাম। ওগুলো মেয়েটির হাতে পড়ার আগেই পড়ল তার আব্বার হাতে। যে পিটুনি দিয়েছিল সেদিন থেকেই কবিতা লেখা বাদ দিয়ে অংকে মনোযোগী হয়েছিলাম। যে ছেলেটা আজ বলেছে পিথাগোরাস একজন উপন্যাসিক, তাকে আমার পক্ষ থেকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। বাবারে একমাত্র তুই বুঝতে পেরেছিস আমার মধ্যে সাহিত্যপ্রেম ছিল!

নিউটনের স্বস্তি

আজকের ভিডিও দেখে মনে হলো আমার জীবনের অন্যতম বড় ভুল আপেল গাছের নিচে বসা! সেদিন যদি আপেল গাছের নিচে না বসতাম, তাহলে এসব অভিকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করতাম না। আর যদি অভিকর্ষ আবিষ্কার না হতো, তাহলে এসব জিপিএ ৫ পাওয়া ছেলেমেয়েরা আজকে দুনিয়ায় থাকত না। অভিকর্ষ না থাকায় তারা অনেক আগেই পৃথিবী থেকে উড়ে গিয়ে নেপালের রাজধানী নেপচুনে চলে যেত! তবে এই ভেবে স্বস্তি লাগছে যে আপেলের কথা বলতে গিয়ে আমার নামটাই বলেছে। স্টিভ জবসের নাম বলেনি। আজকাল তো কেউ কারো ক্রেডিট দিতে চায় না।

ইতিহাসবিদদের দুঃখ প্রকাশ

ইতিহাসবিদরা দুঃখ প্রকাশ করে একটা বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে বলেছেন, আসলে আমরা ইতিহাস লেখার সময় বেশ খাটাখাটুনির মধ্যে ছিলাম। বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর না ২৬ ডিসেম্বর এ রকম অনেক তথ্য আমরা হয়তো ভুল করে ফেলেছি! আজকের ভিডিওতে সে সব ভুল তুলে ধরে নতুন করে সত্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা! আমাদের পক্ষ থেকে তাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। তারা এই তথ্য শুধরে না দিলে আমাদের মধ্যে এসব ভুল থেকেই যেত। আর তা ছাড়া আমরা তো জিপিএ ফাইভ পাইনি। সুতরাং আমাদের পড়াশোনা কম। ভিডিওতে যারা কথা বলেছে, ইতিহাসের নতুন নতুন তথ্য দিয়েছে তারা প্রত্যেকে জিপিএ ৫ পাওয়া। জিপিএ ৫ পাওয়া বিশাল ব্যাপার। তাদের এই জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছি...!

এবং একটা গল্প

কয়েকদিন ধরে মোস্তফা সাহেবের ব্যাপক মন খারাপ। তাঁর একমাত্র ছেলেটা পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি। তাঁর ধারণা ছিল, এখনকার পোলাপান এসএসসিতে জিপিএ ৫ ছাড়া আর কিছু পায় না। অনেকেই তো আজকাল জিজ্ঞেস করে কী ভাই, আপনার ছেলে নর্মাল না গোল্ডেন? অথচ তাঁর ছেলে এসব ধারণার ঊর্ধ্বে রেজাল্ট করেছে। সে জিপিএ ৪.২৫ পেয়েছে! মোস্তফা সাহেব জানতেন সবাই যেহেতু জিপিএ ৫ পায়, তাঁর ছেলেও পাবে। এই ভেবে মিষ্টি এনে শোনেন ছেলে জিপিএ ৪.২৫ পেয়েছে! এটা শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেল। মিষ্টির প্যাকেট ফেলে দিয়ে ছেলেকে জুতাপেটা করলেন। তাঁর মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলেকে অনেক বকাঝকা করলেন। ছেলের সঙ্গে ভালোমতো কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন।

আজ বাড়িতে ফিরেই মোস্তফা সাহেব ছেলেকে ডাকলেন। ছেলে ভয়ে ভয়ে তাঁর সামনে আসতেই তিনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। এই কান্না খুশির কান্না। স্ত্রীকে বললেন ভালো-মন্দ রান্না করতে। স্ত্রী কিছু না বুঝে কারণ জিজ্ঞেস করলে মোস্তফা সাহেব জানালেন, তাঁর ছেলে তাঁর সম্মান রেখেছেন এ জন্যই আজকে আনন্দ উৎসব হবে। ছেলে অবাক হয়ে জানতে চাইল বাবা, আমি তো জিপিএ ৫ পাইনি, তোমার মান-সম্মান নষ্ট করেছি। ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে মোস্তফা সাহেব বললেন না রে বাবা, তুই জিপিএ ৫ না পেয়েই আমার মান-সম্মান রক্ষা করেছিস। আজ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওটা আমিও দেখেছি! এটুকু বলেই মোস্তফা সাহেব আবারও সুখের কান্না কাঁদতে লাগলেন...।