এক রাতেই লাগামহীন পেঁয়াজের বাজার

Looks like you've blocked notifications!
ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর পরই পেঁয়াজের ঝাঁজ আরো বেড়ে বাজারে অস্থির অবস্থা তৈরি হয়েছে। ছবিটি আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি আড়ত থেকে তোলা। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর পরই পেঁয়াজের ঝাঁজ আরো বেড়ে বাজারে অস্থির অবস্থা তৈরি হয়েছে। পাইকারি ও খুচরা উভয় বাজারেই লাগামহীন এখন পেঁয়াজের দাম। গত বছরের একই সময়ে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে অনেকেই এখন বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে মজুদও করে রাখছে। আর ব্যবসায়ীরা তার সবটুকু সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছে, ভারত অভ্যন্তরীণ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

রাজধানীর কয়েকজন পেঁয়াজ ব্যবসায়ী জানায়, পেঁয়াজের দাম যেমন বেড়েছে তেমনি বিক্রিও বেড়েছে প্রচুর। গত বছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে বাজারের যেভাবে আগুন লেগেছিল, এবারও ঠিক তেমন হতে যাচ্ছে। এ আগুন নেভাতেও বেশ সময় লাগতে পারে বলে মনে করছে তারা।

আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, খুচরা বাজারের চেয়ে পাইকারি বাজারে ক্রেতার ভিড় বেশি। জমজমাট বাজারের ভেতরে হঠাৎ নজর গেল ফিরোজ শাহ খোকন নামের এক ক্রেতার দিকে। এক মিনতির (মুটে বা কাজের লোক) মাথায় তিনি ২০ কেজি দেশি পেঁয়াজ উঠিয়ে দিচ্ছেন। কিনেছেন ১০০ টাকা কেজি দরে।

ফিরোজ শাহ খোকন পেঁয়াজ কিনেছেন পাইকারি বিক্রেতা রুবেলের কাছ থেকে। রুবেল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অন্যদিনের চেয়ে আজ অনেক বিক্রি বেড়েছে। এখন মানুষ বাসায় নিয়ে পেঁয়াজ রাখছে।’

আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, খুচরা বাজারের চেয়ে পাইকারি বাজারে ক্রেতার ভিড় বেশি। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ক্রেতা ফিরোজ শাহ বললেন, ‘২০ কেজি পেঁয়াজ আড়াই মাস চলবে। গত বছর ঠিক এই সময়ে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে হু হু করে দাম বেড়ে গিয়েছিল। বহুদিন বেশি দাম দিয়ে পেঁয়াজ কিনে খেতে হয়েছিল। সেই ভয়ে এবার একসঙ্গে ২০ কেজি কিনলাম। কাল খুচরা পেঁয়াজ কিনেছিলাম ৬০ টাকা কেজি দরে। অথচ আজ ১০০ টাকা কেজি দরে পাইকারি কিনলাম। ভাবেন, কেন এতগুলো পেঁয়াজ কিনেছি।’

পাশে নজর যেতেই দেখা গেল, আবদুর রহমান (৬০) নামের এক পাইকারি বিক্রেতার সামনে কয়েকজন সাধারণ ক্রেতা (বাসাবাড়ির জন্য) এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি খুব দ্রুত পেঁয়াজ বের করছেন বস্তা থেকে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে একটু কথা বলতে চাইলেই বৃদ্ধ বলে বসলেন, ‘আজ মাফ করা যায় না চাচা? একা একা বিক্রি করে পারছি না। আজ খুব চাপ। এত চাপ বহুদিন দেখিনি। ১০ বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি করে ফেলেছি এরইমধ্যে।’

আবদুর রহমানের দোকানে মামুন নামের এক ক্রেতা পাঁচ কেজি দেশি পেঁয়াজ কিনেছেন। তিনি বলেন, ‘দাম বেড়ে যাওয়ার ভয়ে বউ জোর করে পেঁয়াজ কিনতে বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছে।’

মাহবুব বাবু নামের এক ব্যবসায়ী ভারতীয় পেঁয়াজের বিক্রেতা। আজ সন্ধ্যা ৬টায় কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘আজ এখন পর্যন্ত ৪০ কেজির বস্তা ২৫টা বিক্রি করেছি। রাতের ভেতরে আরো ১০ বস্তা বিক্রি হবে বলে আশা করছি। অথচ অন্যদিন ১০ বস্তাও বিক্রি হয় না। আজ প্রতি কেজি বিক্রি করেছি ৬৪ টাকা দরে। কিনেছি ৬০ টাকা ৩০ পয়সা করে।’

পাইকারি ও খুচরা দুই বাজারেই ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হতে দেখা গেছে দেশি পেঁয়াজ। খুচরা বিক্রেতা সামাদ হোসেন বলেন, ‘কাল বিক্রি করেছি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে। আজ ১০০ টাকা। কাল আরো দাম বাড়তে পারে। আগুন লেগে গেছে পেঁয়াজে। এই আগুন আরো বেশি জ্বলতে পারে। আগুন নিভতে অনেক দেরি হবে মনে হচ্ছে।’

রাজধানীর শুক্রাবাদ কাঁচাবাজারের খুচরা বিক্রেতা আল মাহমুদ এসেছেন পেঁয়াজ কিনতে। তিনি দুই মণ পেঁয়াজ কিনেছেন। তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম বাড়বে নিশ্চিত। সেজন্য কিনতে এসেছি। আজ একটু বেশি নিলাম।’

পাইকারি ও খুচরা দুই বাজারেই ১০০ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে দেশি পেঁয়াজ। ছবিটি আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজার থেকে তোলা। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

ভারত নিজেদের বাজার সামাল দিতে গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানিতে ন্যূনতম মূল্য টনপ্রতি ৮৫০ ডলার বেঁধে দেয়। ৩০ সেপ্টেম্বর রপ্তানিই নিষিদ্ধ করে দেয় দেশটি। এরপর দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। তখন বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশ পথেও পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। চলতি বছরের মার্চে পেঁয়াজ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ভারত।

গতকাল সোমবার পূর্বঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে বিপাকে পড়ে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারকরা।  

এ বন্দর দিয়ে গতকাল পেঁয়াজ আমদানি না হওয়ায় দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আটকা পড়ে আছে পেঁয়াজবোঝাই ২৫০ থেকে ৩০০ ভারতীয় ট্রাক। এ ছাড়া আমদানির জন্য এলসি করা প্রায় ১০ হাজার টন পেঁয়াজ দেশে আসা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছে এই বন্দরের আমদানিকারকরা।

হিলির সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শংকর দাশ জানান, ভারত সরকারের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর গতকাল সন্ধ্যায় এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকবে।

শংকর দাশ আরো জানান, সাম্প্রতিককালে ভারতে বন্যায় পেঁয়াজের আবাদ নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে মজুদ কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে গেছে। মূলত দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশীদ বলেন, ‘হঠাৎ করেই ভারত সরকার বন্যার কারণ দেখিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে গতকাল হিলি স্থলবন্দর দিয়ে দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। শুধু হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারকরা ১০ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি জন্য ভারতে এলসি করেছে। যার বিপরীতে ২৫০-৩০০ ভারতীয় ট্রাক পেঁয়াজ নিয়ে ভারতে আটকা পড়েছে। এসব পেঁয়াজবোঝাই ট্রাক দেশে প্রবেশ করতে না পারলে পেঁয়াজে পচন ধরে নষ্ট হবে। লোকসান গুনতে হবে আমাদের। আমরা চাই, আমাদের এলসি করা পেঁয়াজগুলো দেশে পাঠানো হোক।’