লাখপতির গল্প

বিদেশ থেকে ফিরে দেশি পণ্যে মন, ১৬ লাখ টাকার নকশীপণ্য বিক্রি লাকীর

Looks like you've blocked notifications!
সফল উদ্যোক্তা ফারহানা আক্তার লাকী। ছবি : সংগৃহীত

দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে যখন দেশে ফেরেন, তখন ফারহানা আক্তার লাকীর জীবন অনেকটাই এলোমেলো ছিল। এখন সে জীবন অনেকটাই গোছানো। নকশীকাঁথাসহ অন্য নকশীপণ্য বেচে এরই মধ্যে লাখপতি বনে গেছেন এ উদ্যোক্তা। তাঁর নকশীপণ্য দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও বিক্রি হচ্ছে। লাকীর অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগ—ফারহানা’স ড্রিম।

সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় ফারহানা আক্তার লাকীর। জানান নিজের উদ্যোক্তা-জীবনের কথা। কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাওয়া, শুরু দিকের কথা। লাকীর জবাব, ‘কাজ করছি দেশের ঐতিহ্যবাহী নকশীকাঁথা আর অন্যান্য নকশীপণ্য নিয়ে। আমার উদ্যোগের বয়স দেড় বছর। নকশীকাঁথাকে সর্বস্তরে জনপ্রিয় করা আর এই কাঁথার সঙ্গে জড়িত আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আবেগের সঙ্গে সবার কাছে পরিচিত করার উদ্দেশ্যেই আমার কাজের শুরু।’

বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে লাকী বললেন, অনেকটাই সফলতার পথে হাঁটছেন। বিলাসী আর শৌখিন পণ্য নয়, নকশীকাঁথা পরিণত হয়েছে ভালোবাসার পণ্যে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও সমাদৃত হচ্ছে নকশীকাঁথা।

এখন বেশ ব্যস্ত জীবন লাকীর। তাঁর ভাষ্যে, ‘শাটডাউডে বাচ্চারা বাসায় আছে, ওদের সময় দিতে হয়, উদ্যোগে নতুন ইনোভেশন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, বিজনেস প্ল্যানে কী কী ইমপ্রুভমেন্ট আনা যায়, সেসব দিকে একটু মনোযোগ দিতে চাই এই সময়। তবে এই গৃহবন্দি সময়ে আমি সফট স্কিলের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং, প্রফেশনাল কোর্স, উই-এর (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) মাস্টার ক্লাস, ওয়ার্কশপগুলো নিয়মিত করছি। যেহেতু আমি একজন অনলাইন উদ্যোক্তা, আমাকে ই-কমার্স সম্পর্কিত জ্ঞান, নিজের পণ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের সাথে সাথে টেকনোলজিতেও সাউন্ড থাকতে হবে। না হলে অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই এই সময়ে লেখাপড়াকেও গুরুত্ব দিচ্ছি। আমার উদ্যোগ Farhana's Dream-এর মূল কাজ হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুই-সুতার যে শিল্পীরা প্রাণহীন কাপড়ের বুকে সুই আর সুতা দিয়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর তাঁদের আবেগ ফুটিয়ে তোলেন, তাঁদের সেই শিল্পকর্মকে তুলে আনা, তাঁদের কাজের যথাযথ মূল্যায়নের দিকে লক্ষ করা।’

লাকীর কথায় স্পষ্ট, উই-এর ফেসবুক গ্রুপ তাঁর উদ্যোক্তা-জীবনকে প্রভাবিত করেছে। উই সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে উই হচ্ছে রূপকথার পরীর হাতে থাকা জাদুর কাঠি। যার ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে জীবনের গতিপথ, পূর্ণতা পাচ্ছে বুকের ভেতরে লালিত স্বপ্নগুলো। ফেসবুকের আট-দশটা গতানুগতিক গ্রুপের বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে দেশীয় পণ্যের নারী উদ্যোক্তাদের একত্র করে তাদের ভেতরে থাকা শক্তিগুলোকে ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম সামাজিক ট্যাবু ভেঙে উই দেখিয়ে দিয়েছে—আমরা নারী আমরা পারি। আমার আজকের পরিচয়, আমার আজকের কর্মস্পৃহা পুরোটাই উই-এর ফেসবুক গ্রুপের অবদান। ই-কমার্স সম্পর্কে জানা, নিজের পরিচিতি তৈরি করা, নিজের পণ্যকে সবার সামনে যথাযথ ভাবে উপস্থাপন করা—পুরোটাই আমি পেয়েছি উই-এর কাছ থেকে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে যখন দেশে  ফিরেছি, জীবন অনেকটাই এলোমেলো ছিল। সে সময় নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে, জীবনকে গুছিয়ে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে শিখিয়েছে উই।’

কী কী পণ্য নিয়ে কাজ করছেন আর বিক্রিই বা কত? লাকী বলেন, ‘আমার মূল ফোকাস পণ্য বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের নকশীকাঁথা। এর পাশাপাশি নকশি কাজের শাড়ি, থ্রি-পিস, ব্যাগ, ওয়ালম্যাট, কুশন কভার, বেডশিট, নকশী শাল, পাঞ্জাবিসহ সব ধরনের পণ্যই আপনি পাবেন আমার উদ্যোগে। তবে বিশেষত্ব হচ্ছে, সব কাজই সুই-সুতার যুগলবন্দি। আমি এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ লাখ টাকার নকশীপণ্য দেশে ও দেশের বাইরে বিক্রি করেছি। তবে এই পণ্য বিক্রির সিংহভাগই এসেছে দেশের বাইরে থেকে।’

উদ্যোক্তা হতে পেরে কেমন লাগছে? লাকী বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ফিল্ড থেকে এসেছি। চাকরি বা রিসার্চ, সেটি ছিল আমার মূল লক্ষ্য। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন নতুন স্বপ্ন দেখায় উই। উই-এ এসেই আমি নিজেকে দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তা হিসেবে ভাবতে শুরু করি আর সেখান থেকেই ই-কমার্স নিয়ে আমার জানা, শেখা। নিজেকে হারিয়ে আবার খুঁজে পাওয়া। হতাশা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসে সফলতার পথে হাঁটা, বুঝতেই পারছেন, এই অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়।’

পরিবার থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন? ফারহানা আক্তার লাকী বলেন, ‘আমি যখন সিদ্ধান্ত নিই দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তা হব, আমাদের হারিয়ে যাওয়া নকশীকাঁথার ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করব, তখন প্রথম সাপোর্ট আমি আমার পরিবার থেকেই পেয়েছিলাম। প্রথম থেকেই আমার কাজের ব্যাপারে আমার হাসব্যান্ড ডক্টর নুরুল হুদা ভূইয়া আমাকে সর্বতোভাবে সাপোর্ট দিয়েছে, সাহায্য করেছে। আমার পরিবারের অন্য সদস্যরাও আমাকে সব সময় মানসিকভাবে উজ্জীবিত রাখে আমার কাজের ক্ষেত্রে। এমনকি আমার দুই ছেলে, তারাও আমার কাজের ব্যাপারে তাদের অবস্থান থেকে যথেষ্ট সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করে। এককথায় বলতে গেলে, আমার পরিবার আমার কাজের অনেক বড় শক্তি।’

পণ্যের মান কীভাবে রক্ষা করেন? ফারহানা আক্তার লাকী বলেন, ‘আমি নিজে সুচি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছোটবেলা থেকে। আমি প্রফেশনাল ভাবে বিভিন্ন ধরনের নকশী সেলাই শিখেছি। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে কাজের মান সম্পর্কে খুবই সচেতন। যাঁরা আমার সাথে কাজ করেন, তাঁরা সবাই জানেন আমি কাজের মানের ব্যাপারে কোনও কম্প্রোমাইজ করি না। কাপড়, সুতা আর সেলাইয়ের ফিনিশিংয়ের দিকে আমি সব সময় লক্ষ রাখি। হাতের কাজ কখনওই মেশিনের কাজের মতো নিখুঁত হয় না। হাতের কাজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। আমি সব সময় সেই বৈশিষ্ট্যটি ধরে রাখার চেষ্টা করি।’

আগামী দিনের পরিকল্পনা কী, উত্তরে লাকী বলেন, ‘নকশীকাঁথার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং গ্রামীণ সংস্কৃতি। আমরা যথাযথ ভাবে নকশীকাঁথাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারিনি। আমি চাই শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও আমাদের নকশীকাঁথা সবার মন জয় করে নেবে নিজের সৌন্দর্য দিয়ে। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া, কোনও ধরনের সমন্বয় ছাড়া যাঁরা বছরের পর বছর আমাদের এই শিল্পকে ধরে রেখেছেন, তাঁদের যদি আমরা একটু পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা দিতে পারি, তাঁরা ইতিহাস তৈরি করতে পারবেন। আমি সেই ইতিহাস করার স্বপ্ন দেখি।’ লাকীর সেই স্বপ্ন পূরণ হোক, এটাই সবার কামনা।