ভারতের বাজার ধরতে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া

ভারতের বাজারকে টার্গেট করে বাংলাদেশে বড় ধরনের জাপানি বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা৷ শুধু তাই নয়, ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায়ও এর বিশেষ গুরুত্ব দেখছেন তারা৷

জাপানের বিনিয়োগ বাংলাদেশে আরও অনেক দেশকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে বলে আশা বিশ্লেষকদের৷ আর এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২৫ খেকে ২৮ এপ্রিল জাপান সফরের কথা রয়েছে৷

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, গত মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশ ও ভারতকে কেন্দ্র করে তিনি এই বিনিয়োগ প্রস্তাব দেন৷ এরপর বাংলাদেশে ১২৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করে জাপান সরকার৷

জাপানের বিনিয়োগ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে একটি শিল্পাঞ্চল তৈরি৷ তারা শিল্প স্থাপন ও বন্দর তৈরিতে বিনিয়োগ করবে৷ শিল্পাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানে বাজারজাত করতে চায়৷ এজন্য তারা যোগাযোগ অবকাঠামোও গড়ে তুলতে চায়৷ জাপান ১৩০ কোটি মানুষের আবাসস্থল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং বঙ্গোপসাগর এলাকায় উন্নয়নে নজর দেবে৷

বাংলাদেশের তিনটি অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে জাপান। এর মধ্যে আছে মাতারবাড়ি এলাকায় নতুন একটি বাণিজ্যিক বন্দর৷ এই বন্দরের সঙ্গে ত্রিপুরাসহ ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল সংযুক্ত হবে৷ তবে এই বন্দরের মাধ্যমে তারা বৃহত্তর আন্তর্জাতিক বাজারও ধরতে চায়৷  

ভারতে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোশি সুজুকি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় এক বৈঠকে বাংলাদেশ, ভারত ও জাপানের মধ্যে এই প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন৷ ত্রিপুরায় দুই দিনের এ বৈঠক আয়োজন করেছিল গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স৷

হিরোশি সুজুকি জানান, গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ ২০২৭ সালের মধ্যে হতে পারে৷ এই বন্দর শিল্পাঞ্চল নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে৷

রাষ্ট্রদূত সুজুকি আরও জানান, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে তিন শতাধিক জাপানি কোম্পানি কাজ শুরু করেছে৷ দুই দেশের মধ্যে শিগগিরই অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি হতে পারে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে শিল্প উৎপাদন বাড়বে এবং আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে৷ 

বৈঠকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলবিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জি কিশান রেড্ডি জাপানের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান৷ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, এর মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে এবং জাপানসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ আসার পথ সুগম হবে৷

এশিয়ান কনফ্লুয়েন্সের প্রধান সব্যসাচী দত্ত বলেন, মাতারবাড়ি বন্দর থেকে ত্রিপুরার দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটার৷ ফলে মাতারবাড়ি বন্দর ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রপ্তানিকারকদের প্রবেশদ্বার হতে পারে৷

চীন তার আলোচিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে জাপান ও ভারত তার বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ করছে৷

জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার শহীদ বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি ট্রেড হাব গড়ে তোলার জন্য অনেক আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছে৷ এর আগে যখন প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর করেন, তখনও এটা নিয়ে আলোচনা হয়৷ এখন যে প্রস্তাব এসেছে, এটা একটা গেম চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হবে৷ এটা আমাদের অর্থনীতিতে দারুণ প্রভাব ফেলবে৷ ভারতের সেভেন সিস্টার্স-এর সুবিধাটা আমরা অনেক দিন ধরে নিতে পারি নাই৷ এটা আমাদের সুযোগ করে দেবে৷ মাতারবাড়ির ডিপ সি পোর্ট (গভীর সমুদ্রবন্দর) একটা বড় হাব হবে৷’

আনোয়ার শহীদ আরও বলেন, ‘এখানে জাপানি শিল্প এবং এসএমই হবে৷ তাতে আমরা আরও লাভবান হব৷ কর্মসংস্থানও হবে৷ আড়াইহাজারে তাদের যে একটি শিল্পঞ্চল হচ্ছে, সেটা একটা ইউনিক মডেল হবে৷’

এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল বা ভুটানের বাজার যে খুব বড়, তা কিন্তু নয়৷ তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ৷ এটা বিশ্বের আরও অনেক দেশকে এখানে বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে৷ আর তখন বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজার হতে পারে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারসহ আরও অনেক দেশ৷ এছাড়া ইউরোপেও বাজার বিস্তৃত হতে পারে৷ ভারতের মূল বাজারও টার্গেট হতে পারে৷’

গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘সাধারণত জাপানিরা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে৷ তারা যে শুধু টেকনোলজি নিয়ে আসে, তা নয়। তারা এখানকার স্থানীয় শ্রমিকদেরও দক্ষ করে তুলবে৷’

এটি ভূ-রাজনীতির দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক৷ তিনি বলেন, ‘জাপানি বিনিয়োগ এখানে চীনা বিনিয়োগের সঙ্গে একটা ভারসাম্য তৈরি করবে, যেটা বৈদেশিক সম্পর্কের ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে৷ তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে শুধু ডিপ সি পোর্ট নয়, তারা যেন এখানে শিল্পও গড়ে তোলে।’