ভৈরবের পাদুকা কারখানা সীমিত আকারে খুলে দেওয়ার দাবি

Looks like you've blocked notifications!
কিশোরগঞ্জের ভৈরব শহরের গোধূলিসিটি এলাকার গ্রেট ফুটওয়্যারে প্রায় চার কোটি টাকার উৎপাদিত পাদুকার মজুদ পড়ে আছে। ছবি : এনটিভি

মহামারি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশনায় বন্ধ আছে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের বিকাশমান পাদুকাশিল্পের কারখানা। কারখানা বন্ধ থাকায় হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, রোজার ঈদকে কেন্দ্র করেই এখানকার পাদুকাশিল্পের অর্থনীতির চাকা ঘুরে। তাই আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে কারখানাগুলো সীমিত আকারে খুলে দেওয়া ও উৎপাদিত পাদুকা দেশব্যাপী বিক্রির সুযোগ দাবি সংশ্লিষ্টদের।

রাজধানী ঢাকার পরই দেশের পাদুকাশিল্পের সবচেয়ে বেশি বিকাশ ঘটেছে নদীবন্দর ভৈরবে। অবিভক্ত ভারত বিভক্তির পর তৎকালীন পূর্ববাংলার রাজধানী কলকাতা শহরে পাদুকাশিল্পে কাজ করা এখানকার কারিগররা নিজ এলাকায় এসে অল্প পরিসরে গড়ে তুলেছিল পাদুকাশিল্প কারখানা। তখন ভৈরব অঞ্চল ছিল তাঁতশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবের পাদুকা কারখানাগুলোতে এখন সুনসান নীরবতা। ছবি : এনটিভি

১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের তাঁতশিল্পের বিপর্যয়ের ঢেউ ভৈরবেও লাগে। পর্যায়ক্রমে এখানকার তাঁতশিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কর্মহারা তাঁতশিল্পের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে তুলেন পাদুকা কারখানা। যেগুলো বর্তমানে ফুলে-ফেঁপে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০-১২ হাজার কারখানায় রূপ নিয়েছে। যার মধ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ রপ্তানিমুখী ৮-১০টি বড় পরিসরের কারখানাও আছে। আর এসব কারখানায় এক লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করে। নারী শ্রমিক কাজ করে ১৫ থেকে ২০ হাজার। ফলে কৃষির পরে এখানকার মানুষের কর্ম ও অর্থনীতি এই শিল্পকে ঘিরেই।

ভৈরবের পাদুকা কারখানার মালিকরা জানান, সারা বছর তাদের উৎপাদন এবং বিক্রি অল্প স্বল্প হলেও, রমজানের দুই আড়াই মাস আগে থেকে পুরোদমে বিক্রি শুরু হয়। এ সময় প্রতিটি কারখানা কর্মমুখর হয়ে ওঠে। শ্রমিক-মালিকরা দিন-রাতের প্রায় ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। যত বেশি শ্রম, তত বেশি উৎপাদন। আর যত বেশি উৎপাদন, তত বেশি মজুরি আর মুনাফা। তাই তারা দিন-রাতের ব্যবধান ভুলে যান।

কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে সেই কর্মমুখর কারখানাগুলো বন্ধ রয়েছে। সেগুলোতে এখন বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। কাঁচামাল আর যন্ত্রপাতিগুলোতে মিশে আছে ধুলোবালি। কাজ হারিয়ে শ্রমিকরা দিনযাপন করছেন অর্ধাহার-অনাহারে। আর মালিকরা কষছেন লোকসানের ধারাবাহিক অঙ্ক। কারখানার ভাড়া, বিদ্যুৎ-জেনারেটর, গ্যাস বিল, ব্যক্তি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আনা ঋণের সুদ।

পাদুকা কারখানার মালিকরা জানান, কারখানার আকার অনুযায়ী, সেগুলোতে লাখ থেকে কোটি টাকার উৎপাদিত পাদুকার মজুদ পড়ে আছে। যা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করে গত মৌসুমের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ বকেয়া পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই ঈদে যদি সরবরাহ বন্ধ থাকে, তবে বকেয়া পাওয়ার সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে বড় রকমের লোকসানের মুখে পড়বেন কারখানার মালিকরা। আর্থিক লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যাবে কারখানাগুলো। কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে আর্থিক অভাব-অনটনে পড়বেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক-মালিক।

ভৈরব শহরের গোধূলিসিটি এলাকার গ্রেট ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সহিদ মিয়া জানান, তাঁর কারখানায় প্রায় চার কোটি টাকার উৎপাদিত পাদুকার মজুদ পড়ে আছে। আর এই মৌসুমে তাঁর কারখানায় আরো চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার পাদুকা তৈরি হতো। এসব উৎপাদিত পাদুকা বিপণনের মাধ্যমে তাঁর কমপক্ষে চার কোটি টাকা মার্কেট থেকে তহবিলে আসত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সবই শূন্যের কোটায়। উৎপাদন,বিক্রি এবং আয়-সবই স্থবির। ফলে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়েছেন তিনি। অন্যদিকে তাঁর কারখানায় কর্মরত ৩০০ শ্রমিককে মার্চ মাসের বেতন দিয়েছেন ধার করে। এপ্রিলের বেতন পরিশোধ নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়।

একই বিপর্যয়ের কথা জানালেন শহরের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এয়ারমেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমির হোসেন। তিনি সামাজিক দূরত্ব মেনে তাদের কারখানাগুলো সীমিত আকারে খুলে দেওয়ার দাবি জানান। বলেন, তাঁর রপ্তানিমুখী এই কারখানা থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ও ভারতে পাদুকা রপ্তানি করে থাকেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সব বন্ধ। সীমিত আকারে কিছু পাদুকা উৎপাদন করা গেলে শ্রমিকদের বেতনাদি পরিশোধ করা যেত।

কমলপুর এলাকার ঐশী সেন্ডেল কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাছির উদ্দিন জানান, তাঁর কারখানায় ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মাসিক বেতন আসে প্রায় সাড়ে ২২ লাখ টাকা। কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন বন্ধ। বিক্রি বন্ধ থাকায় আয় বন্ধ। কিন্তু শ্রমিকের বকেয়া বেতন, কারখানা ভাড়া, কারেন্টবিল, ব্যাংক ঋণের সুদ, সব বেড়ে চলছে।

নাছির উদ্দিন দাবি করেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা যদি না পান, তবে পরিস্থিতি ভালো হলেও তাঁর কারখানা চালু করা সম্ভব হবে না।

একই এলাকার সবুজ ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সবুজ মিয়া জানান, পাদুকা হলো নিত্যনতুন ডিজাইন নির্ভর। এই মৌসুমের ডিজাইনটি পরের মৌসুমে ক্রেতাদের নজর কাড়বে না। তাই এই মৌসুমকে উপলক্ষ করে তাঁরা উৎপাদনের যে মজুদ সারা বছর গড়ে তুলেছেন, সেটি আগামী মৌসুমে আর টিকবে না বাজারে। আর বাজারে বিক্রি না করতে পারলে গত মৌসুমের বকেয়া আর উঠানো সম্ভব হবে না। ফলে তারা বড় রকমের লোকসানে পড়ে যাবেন। যা কাটিয়ে উঠা কঠিন হয়ে পড়বে।

ভৈরব বাজারের বাগানবাড়ি এলাকার সাগর ফুট ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ভৈরব চেম্বারের সাবেক সভাপতি আলহাজ আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, পাদুকা শিল্পের বিপর্যয় ঘটলে ভৈরবের অর্থনীতিতে এক বিরাট বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। কারণ, এই পাদুকাকে কেন্দ্র করে এখানে কাগজ তৈরির বোর্ড মিল থেকে শুরু করে,র‌্যাকসিন, রং, চামড়া, বক্স ইত্যাদিসহ আনুষঙ্গিক অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব খাতে বিনিয়োগ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থানসহ জীবন-জীবিকার চাকা ঘুরে কয়েক লাখ লোকের। তাই এই বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারকে সঠিক সময়ে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আল আমিন মিয়া দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনা অনুযায়ী সীমিত আকারে তাদের কিছু কারখানা যেন খুলে দেওয়া হয়। যাতে করে তাঁরা এই রমজানের ঈদের মৌসুমটাকে কাজে লাগাতে পারেন। ধান যেমন একটি জরুরি বিষয়, তেমনি পাদুকাকেও বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদন এবং বিক্রির ব্যবস্থার দাবি করেন তিনি।

এদিকে ভৈরব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আলহাজ মো. হুমায়ুন কবির পাদুকা কারখানা মালিকদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে জানান, ভৈরব চেম্বারের পক্ষ থেকে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে কিছু কিছু কারখানা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুবনা ফারজানা জানান, পাদুকা কারখানা ভৈরবের একটি বড় শিল্প মাধ্যম। যেখানে বহু লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি তাদের সমস্যার বিষয়ে অবগত আছেন। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে এই বিষয়ে তিনি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।