‘লবণের বাজার স্বাভাবিক, কোনো ঘাটতি নেই’
দেশে লবণের বাজার স্বাভাবিক আছে। কোনো ধরনের ঘাটতি নাই। বর্তমানে যে পরিমাণ লবণ উদ্বৃত্ত রয়েছে তা দিয়ে আরো অন্তত দুই মাস চলবে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী লবণের সংকট দেখিয়ে দাম বৃদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
আজ মঙ্গলবার কক্সবাজারে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সভায় মিল মালিকরা এসব কথা বলেন। কক্সবাজার শহরের একটি হোটেলে ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় জানানো হয়, এরইমধ্যে একটা কুচক্রিমহল লবণের কেজি ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে অপপ্রচার চালিয়েছে। তারা মূলত এ শিল্পকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। অপপ্রচারকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বলেছেন, ‘বর্তমানে তিন লাখ মেট্রিক টনের ওপরে লবণ উদ্বৃত্ত। কিছু মিল মালিকের কারণে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সোডিয়াম সালফেট বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে। বন্ড লাইসেন্স, কাস্টিং সল্ট ইত্যাদি নামে লবণ আমদানি করছিল একটা শ্রেণি। আমাদের কঠোরতায় ওই রকম লবণ আমদানি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি।’
নুরুল কবির বলেন, ‘লবণের জাতীয় চাহিদা নিরূপণে সবাইকে এক টেবিলে বসতে হবে। আমরা লবণ ব্যবসায়ী ঐক্যবদ্ধ হলে এই শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব। ঘরের সমস্যা ঘরেই সমাধান চাই।’
লবণ মিল মালিকদের ওই সভায় বক্তব্য দেন সমিতির সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম, আফতাব হোসেন, মাস্টার আব্দুল কাদের, এম কায়সার ইদ্রিস, মো. ফজলুল হক, ওমর ফারুক মিঠু, সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী।
সভায় কার্যনির্বাহী সদস্য মো. আবু হানিফ ভূঁইয়া, মো. শহিদুজ্জামান শরিফ, আলহাজ মো. কামাল দেওয়ান, মো. আবুল কালাম আজাদ, হাজি এস এম ইজ্জত আলী, মীর আহম্মদ, সাদেক মোহাম্মদ, এম এ তাহের, গাজী সাব্বির আহমদ, অহিদুস সামাদ হেলাল, মো. কুতুব উদ্দিন, ফরিদুল ইসলাম, শেখ ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, অছিয়র রহমান চেয়ারম্যান, জাফর আহম্মদ, মো. মো. কামাল শরীফসহ দেড়শতাধিক মিল মালিক উপস্থিত ছিলেন।
মিল মালিকরা বলেন, ‘আয়োডিনের সর্বোচ্চ এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ হওয়া দরকার। কিন্তু আমাদের কিনতে হচ্ছে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দামে। আয়োডিনের দাম কমানো প্রয়োজন।’
সভায় লবণ মিল মালিকরা আরো বলেন, ‘কালো বাজারি, উৎপাদিত লবণের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া ও বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেটের কারণে ধ্বংস হচ্ছে দেশি লবণ শিল্প। মাঠে ও মিলে পড়ে রয়েছে অন্তত ছয় লাখ অবিক্রিত লবণ। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে কালো বাজারিদের লবণ আমদানির কারণে দেশি লবণ খাত মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারছে না। পিছিয়ে যাচ্ছে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ খাত। দরপতন অব্যাহত থাকলে সামনের মৌসুমে লবণ চাষিরা মাঠে যাবে কি না সন্দেহ রয়েছে।’
লবণ মিল মালিক, ব্যবসায়ী, চাষিসহ সংশ্লিষ্টদের দাবী, দেশীয় লবণশিল্প বাঁচাতে সব লবণ আমদানি বন্ধ করতে হবে। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে না পারলে মাঠে ফেরানো যাবে না চাষিদের। পরনির্ভর হবে দেশ। বাড়বে বেকারত্ব। সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট, সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করে তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
মিল মালিকরা জানান, ৮০ কেজির লবণের বস্তা মাঠ পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা দরে। সে হিসেবে কেজিতে পড়ছে মাত্র ৪ টাকা। যা দিয়ে মজুরি বা উৎপাদন খরচও সামাল দিতে পারছে না চাষিরা। অথচ বাজারে প্যাকেটজাত লবণ কেজিতে বিক্রি করা হয় প্রায় ৩৫-৪০ টাকা। উৎপাদনের পর থেকে বাজারে পৌঁছানো পর্যন্ত অন্তত তিনটি হাত বদল হয় লবণের। প্রত্যেক হাতে লাভ পড়ে। কেবল লোকসান সয়েই যেতে হচ্ছে ‘চিরবঞ্চিত’ চাষিদের।
লবণ মিল মালিকদের একটি সূত্র জানায়, অপরিশোধিত লবণ পরিশোধিত তথা খাবার উপযুক্ত ও বাজারজাত করতে কেজিতে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় টাকা খরচ পড়বে। ওই হিসেবে এক কেজি লবণের দাম হওয়ার কথা সাড়ে পাঁচ টাকার নিচে। কিন্তু বাজারে ভোক্তারা কিনছে প্রায় ৩৫-৪০ টাকায়। লবণ চাষিদের অবহেলা, রাঘববোয়াল ও শিল্প কারখানার মালিকদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ‘দরদি মনোভাব’-এর কারণে এমনটি হচ্ছে বলে ধারণা সাধারণ মানুষের।
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে লবণের মৌসুম। এরইমধ্যে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। গত মৌসুমেও অন্তত ছয় লাখ টন লবণ উদ্বৃত্ত আছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ মৌসুমে বিসিকের চাহিদা ১৮ লাখ ৪৯ হাজার টন। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে কক্সবাজার জেলায় উৎপাদনযোগ্য লবণ জমির পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৫৯৬ একর। চাষির সংখ্যা ২৯ হাজার ২৮৭ জন। এই মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ লাখ টন। বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার টন। যা গত ৫৮ বছরের লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।