৮-১০ টাকায় বিক্রি করে ১৩০ টাকায় পেঁয়াজ কিনেছেন কৃষক
একটু কমে পেঁয়াজ কেনার জন্য মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার চান্দেরচর বাজারের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘোরেন কৃষক ইসকান দড়ি (৭০)। অনেক ঘোরাঘুরির পর ১৩০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনতে পারেন তিনি।
অথচ এই কৃষকই তিন-চার মাস আগে গত পেঁয়াজ মৌসুমের শুরুতে আট-দশ টাকা কেজিতে নিজের ক্ষেতের পেঁয়াজ বিক্রি করেছিলেন। কিছুটা পেঁয়াজ রেখে দেন ভালো দামের আশায়। সেটাও কিছুদিন পর ১৮ থেকে ২০ টাকায় বেঁচেন, কিন্তু তাতেও চালান ওঠেনি। অথচ এখন তাঁকেই ১৩০ টাকা কেজি ধরে পেঁয়াজ কিনতে হয়।
অঞ্চলভিত্তিক ফসল সংরক্ষণাগার বা হিমাগার না থাকা ও বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবেই ইসকান দড়ির মতো কৃষকের হাত শূন্য থাকার নেপথ্য কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
নদ-নদী, খাল-বিল সমৃদ্ধ মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরের কৃষি জমিতে প্রতি বর্ষায় পর্যাপ্ত পলি পড়ে। ফলে বাম্পার ফলন হয় পেঁয়াজ, রসুন, টমেটোসহ শাকসবজির। কিন্তু উৎপাদন মৌসুমে সংরক্ষণের অভাবে কৃষক এসব পানির দামে বেচতে বাধ্য হন।
গত বছর মাদারীপুরের চার উপজেলায় প্রায় চার হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়। ফলন আসে ৯০ হাজার টন। কিন্তু পচনশীল এ পণ্য শুধু সংরক্ষণের অভাবে পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন এ অঞ্চলের কৃষকরা। এবার উৎপাদন মৌসুমে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল আট থেকে দশ টাকা। আরো নিম্নমুখী ছিল রসুনের দাম। দাম কম থাকায় ও সংরক্ষণাগারের অভাবে পেঁয়াজ উত্তোলন না করায় বৃষ্টিতে মাঠেই পচে যায় বিপুল পেয়াজ, রসুনসহ রবি শস্য। বৃষ্টিতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা।
এ ছাড়া অনেকেই বাড়িতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অনুকূল পরিবেশের ফলে উৎপাদনও হয়েছিল বাম্পার। কিন্তু ভালো ও উন্নতমানের ফসল ফলিয়েই কৃষক পড়ে বিপাকে। মাদারীপুরসহ এই অঞ্চলে ফসল সংরক্ষণে কোনো সংরক্ষণাগার বা হিমাগার না থাকায় পানির দরেই বিক্রি করতে হয় কষ্টার্জিত ফসল।
শিবচর বাজারের সবজি ব্যবসায়ী রুহুল আমিন বলেন, ‘বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১২৫ টাকায় কিনে ১৩০ টাকায় বিক্রি করি। এই পেঁয়াজ এক দেড় মাস আগে কেজি ছিল ৩০-৪০ টাকা। এক দেড় মাসের মধ্যে কয়েক দফা দাম বেড়েছে। আমরা যেমন কিনি তেমনি বিক্রি করি।’
আরেক ব্যবসায়ী মোতাহার বলেন, কয়েক মাস আগে যখন আমাদের অঞ্চলের পেঁয়াজ উঠেছিল তখন বাজারে কৃষকরা ১০-১৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। তখন যদি পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে বা কোল্ড স্টোরে রাখা যেত তাহলে এখন পেঁয়াজের দাম এত বাড়ত না। সারা বছরই কম দামে পেঁয়াজ খাওয়া যেত।’
ক্ষতিগ্রস্ত পেঁয়াজচাষি ইসকান দড়ি বলেন, ‘আমি এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম। দিনমজুর নিয়ে যখন পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে তুললাম তখন বাজারে প্রতি কেজির দাম আট থেকে দশ টাকা। আমি কয়েক দিন অপেক্ষা করে ঢাকার শ্যামবাজারে পেঁয়াজ নিয়ে ১৬-১৮ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছিলাম। তাতেও আমার চালান উঠেনি।’
ইসকন দড়ি বলেন, ‘আমার মতো সব কৃষকই গত বছর পেঁয়াজে লোকসান খেয়েছে। আজ বাজার থেকে ১৩০ টাকা কেজিতে খাওয়ার জন্য পেঁয়াজ কিনলাম। যে পেয়াজ আট-দশ টাকায় বিক্রি করলাম সেই পেঁয়াজই আজ ১৩০ টাকায় কিনতে হলো। যদি আমাদের অঞ্চলে কোল্ড স্টোর থাকত তাহলে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারতাম। আমরাও লসে পড়তাম না। আর সব মানুষই কম দামে পেঁয়াজ কিনতে পারত।’
শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ অনুপম রায় বলেন, ‘এ অঞ্চলে খুব ভালো মানের পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। তবে পেঁয়াজ উত্তোলন মৌসুমে বেশি পরিমাণ আমদানি থাকায় কৃষকরা কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অনেক কৃষক লোকসানের মুখেও পড়ে। এ জন্য কৃষক ও কৃষিকে বাঁচাতে অঞ্চল ভিত্তিক সংরক্ষণাগার বা কোল্ড স্টোর নির্মাণ করা প্রয়োজন।’
তবে দেশীয় পদ্ধতিতে ছয় মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় জানিয়ে কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা কৃষকদের ওই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণের কথাও বলছি, সেই পদ্ধতি আমরা শেখাচ্ছি।’