সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পে বিপর্যয়
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পে। পর্যটক কমছে আশঙ্কাজনক হারে। বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের। ২০১২-১৩ অর্থবছরের চেয়ে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পর্যটক চারগুণ ও রাজস্ব আহরণ তিনগুণ কমেছে। আর চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে রাজস্ব আহরণে ধস নামবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, পর্যটন মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ ) সুন্দরবন এলাকা ঘুরতে আসেন দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক-দর্শনার্থী। এ সময় সুন্দরবনের করমজল, হারবাড়িয়া, হিরণপয়েন্ট, কটকা ও কঁচিখালী এলাকা প্রতিদিন পর্যটকদের আগমনে মুখর থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেই মূলত চলতি মৌসুমে বিপর্যয় নেমে এসছে পর্যটনশিল্পে। ফলে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাবে সরকার।
বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, পূর্ব সুন্দরবনে ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশি পর্যটক-দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮০ হাজার ২১৭ জন ও বিদেশি পর্যটক ছিল তিন হাজার ৮৫৪ জন। ওই অর্থবছরে মোট রাজস্বের পরিমাণ ছিল এক কোটি তিন লাখ ৬৮ হাজার ৮৯০ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশি পর্যটক-দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৩ হাজার ২৭৮ জন এবং বিদেশি পর্যটক দুই হাজার ৮৬৫ জন। ওই অর্থবছরে রাজস্ব আহরিত হয়েছিল ৬৭ লাখ চার হাজার ৬০ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে (ডিসেম্বর, ২০১৪ পর্যন্ত) দেশি পর্যটক-দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার ৯৪০ জন আর বিদেশি পর্যটক ছিল এক হাজার ৯৮১ জন। এ সময়ে রাজস্ব আহরিত হয়েছে ৪৫ লাখ ৮৯ হাজার ৩৮৫ টাকা। চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে রাজস্ব আহরণে ধস নামবে বলে মনে করেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ১৫-২০ জন পর্যটক ঘুরতে এসেছেন। তারা মংলা ও পার্শ্ববর্তী রামপাল উপজেলার বাসিন্দা। দূরের কোনো পর্যটকের দেখা মেলেনি।
করমজল পর্যটন ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রল্লাত চন্দ্র রায় এনটিভিকে বলেন, ‘গতবছর এ সময় কেন্দ্রে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার পর্যটক ভিড় জমাত। কিন্তু এ বছর এই সময় দৈনিক গড়ে ৫০-৬০ জন পর্যটক দেখা যাচ্ছে। অবরোধের কারণে পর্যটকরা সুন্দরবনে আসতে পারছেন না। গত বছরেও হরতাল-অবরোধের কারণে এ পর্যটন কেন্দ্রের রাজস্ব আহরণ কমেছিল। চলতি বছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ লাখ টাকা। এ রকম পরিস্থিতি চললে তা অর্ধেকে নেমে আসবে।’
লাগাতার অবরোধের কারণে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য। পর্যটক না থাকায় মংলার লঞ্চ ও ট্যুরিস্ট বোট মালিকরা হাত গুটিয়ে বসেছেন।
মংলা লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সুন্দরবন লাইভ ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী গোলাম রহমান বলেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আমার লঞ্চে সুন্দরবন ভ্রমণের আটটি ট্যুরের বুকিং ছিল। কিন্তু অবরোধের কারণে তা বাতিল করেছেন ট্যুরিস্টরা। এতে আমার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। একই অবস্থা অন্য লঞ্চ-মালিকদেরও। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না হলে এ ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে।’
মংলা ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসাইন মোহাম্মদ দুলাল বলেন, ‘মংলায় ২৫০ থেকে ৩০০ ট্যুরিস্ট বোট, লঞ্চ ও অন্য নৌযান রয়েছে। এতে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বেশ কিছু দিন ধরে পর্যটক নেই বললেই চলে। কোনো আয় নেই। আমরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। বোটের কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছি না। শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।’
হরতাল-অবরোধে মংলার আবাসিক হোটেলগুলো এখন শূন্য পড়ে আছে। চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন তারা।
মংলা পর্যটন হোটেল পশুরের অফিস ব্যবস্থাপক আবদুল মালেক বলেন, ভরা মৌসুমেও আমাদের হোটেল শূন্য পড়ে আছে। এ সময় আমাদের হোটেলের ১৬টি কক্ষ পর্যটকে ভরপুর থাকে। কক্ষ খালি না থাকায় প্রতিদিন ১৫-২০ জনকে ফিরিয়ে দিতে হতো। কিন্তু এখন আমরা কোনো পর্যটক পাচ্ছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে চলতি মাসে আমাদের ছয়-সাত লাখ টাকার ক্ষতি হবে।’