ফিল্ড মিল্ক পাউডার আমদানিতে শুল্ক কমলে কী প্রভাব পড়বে

বাজেট উপস্থাপনার মাসখানেক আগে সিলেটে আয়োজিত একটি বেসরকারি টেলিভিশনের বাজেট সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, দেশের দুগ্ধশিল্প নিয়ে সরকারের যে পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে বছর দু-এক পর আর গুঁড়া দুধ আমদানি করতে হবে না। দেশের দুগ্ধশিল্পকে রক্ষা করতে গুঁড়া দুধ আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর কথা ভাবছেন বলেও জানান তিনি।
কিন্তু সংসদে দেওয়া বাজেট প্রস্তাবনায় একেবারেই উল্টোপথে হাঁটলেন অর্থমন্ত্রী। ফিল্ড মিল্ক পাউডার (এফএমপি) আমদানির ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয় বাজেটে। আর অর্থমন্ত্রীর এই প্রস্তাবনায় স্তম্ভিত হয়ে যান দুগ্ধশিল্প সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পূর্ণ ননিযুক্ত পাউডার দুধ (ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার) আমদানি হয়ে আসছে বহু যুগ ধরেই। পূর্ণ ননিযুক্ত পাউডারে দুধের সব গুণাগুণই থাকে। তবে ফিল্ড মিল্ক পাউডার হচ্ছে এমন একটি দুধ, যেখানে দুধের স্বাভাবিক ননি সরিয়ে তা ভেজিটেবল ফ্যাটে পূর্ণ করা হয়। অনেকেই একে বলে থাকেন কৃত্রিম ননি। স্বাভাবিকভাবেই এটি ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডারের মতো মানসম্মত নয়।
দামে কম হওয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরেই বেশ কিছু আমদানিকারক ফিল্ড মিল্ক পাউডার আমদানি করে বাজারে বিভিন্ন মোড়কে বিক্রি করে আসছেন, যা নিয়ে এরই মধ্যে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। অন্যদিকে, কম মূল্যের এ দুধের ব্যবহার বাড়ছে মিষ্টি তৈরি এবং এ সংশ্লিষ্ট শিল্পে। ফলে খামারিরা দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। লোকসানের মুখে অনেক দুধ উৎপাদন খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখানে এই আমদানি শুল্ক ৭০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৭০ শতাংশ এবং কানাডায় এই শুল্ক ২৭৫ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে তা বাড়ানোর পরিবর্তে কমানো হয়েছে। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
‘অন্য দেশগুলো যেখানে তাদের দুগ্ধশিল্পকে বেড়ে উঠতে সহায়তা করছে, সেখানে আমাদের দেশের সরকার কী করছে? এ শুল্ক কমানোয় দেশের দুগ্ধশিল্প ধ্বংসের দিকে যাবে। আর ফিল্ড মিল্ক পাউডারের পুষ্টিগুণও খারাপ, যা মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বাড়াবে,’ বলেন ইমরান হোসেন।
সাধারণত গুঁড়া দুধের সবচেয়ে বড় ভোক্তা শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা। ফলে এ ধরনের পাউডার দুধ আমদানি তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বাড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন ডা. এস কে রায় বলেন, ‘আমরা দুই বছরের শিশুদের মায়ের দুধ খেতে পরামর্শ দিই। তারপরও অনেকে বাচ্চাদের গুঁড়া দুধ খাওয়ান। শিশু ছাড়া বড়রাও নানাভাবে গুঁড়া দুধ খেয়ে থাকেন। এখন এই ফিল্ড মিল্ক পাউডার আমদানি উৎসাহিত করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বাড়বে।’ ডা. রায় বলেন, ‘ভেজিটেবল অয়েলের ক্ষেত্রে যদি পাম অয়েল মেশানো হয়, তবে তা ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে। আর পাম অয়েল সস্তা হওয়ায় এটি মেশানোর সম্ভাবনাই বেশি। কাজেই এ মান নিয়ন্ত্রণ কে করবে?’
এটি মানুষের পুষ্টিতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন ডা. এস কে রায়।
বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার মহুয়া বলেন, সাধারণ দুধে এবং পূর্ণ ননিযুক্ত পাউডার দুধে যে ভিটামিন এ এবং অন্যান্য দ্রবীভূত ভিটামিন পাওয়া যায়, তা ফিল্ড মিল্ক পাউডারে পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া ফিল্ড মিল্ক পাউডারে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডেরও ঘাটতি থাকবে। ফলে ফিল্ড মিল্ক পাউডার বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে জানান পুষ্টিবিদ মহুয়া। তা ছাড়া সাধারণ এবং পূর্ণ ননিযুক্ত দুধে অদ্রবণীয় ৮০ শতাংশ ও দ্রবণীয় ২০ শতাংশ প্রোটিন থাকে, তা ভেজিটেবল ফ্যাট দিয়ে তৈরি পাউডার দুধে কতটুকু নিশ্চিত করা হবে, তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন এ পুষ্টিবিদ।
‘এ পাউডার দুধ আমদানি বাড়লে তা হবে মানুষের স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের বড় কারণ। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা পড়বেন সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে। কারণ, তাদের ভিটামিন এ সরবরাহ এই ফিল্ড মিল্ক পাউডার দুধ থেকে পাওয়া যাবে না, এ ছাড়া হাইপার টেনশনড রোগীদের জন্যও কোনো উপকারে আসবে না এই দুধ,’ বলেন শামসুন্নাহার মহুয়া।
অ্যাপোলো হসপিটাল ঢাকার প্রধান পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী বলেন, দুধের মধ্যে যে চর্বি পাওয়া যায়, তা দুধের প্রাকৃতিক চর্বি। যা শরীরের মধ্যে খুব সহজেই শোষিত হয়। কিন্তু ফিল্ড মিল্ক পাউডার দুধে যেহেতু প্রাকৃতিক চর্বি সরিয়ে ভেজিটেবল ফ্যাট, বিশেষ করে পাম অয়েল ব্যবহার করা হয়, কাজেই তা মানব শরীরে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি করবে। এ ধরনের দুধ ও দুধ থেকে তৈরি খাবার দীর্ঘদিন খেলে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বেড়ে যাওয়া এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে।
‘উন্নত বিশ্বে ফিল্ড মিল্ক পাউডার ব্যবহারে বেশ কিছু বিধিনিষেধ ও আইনকানুন রয়েছে। আর আমাদের চারদিকে য়েখানে ভেজালের ছড়াছড়ি, সেখানে মান নিয়ন্ত্রণ, সঠিক মনিটরিং, সত্যিকারের পুষ্টি উপাদানের তথ্য (লেবেলিং) নিশ্চিত করা কঠিন আর সেটি করতে না গেলে এ ধরনের দুধ মানব শরীরের জন্য খবুই ক্ষতিকর হবে,’ বলে জানান তামান্না চৌধুরী।
পুষ্টিগত দিক থেকে তা যেমন উদ্বেগের, তেমনি দেশের বিকাশমান দুগ্ধশিল্পের জন্যও অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণা আত্মঘাতী বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মোসাদ্দেক হোসেন।
‘ফিল্ড মিল্ক পাউডার দুধ আমদানিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে,’ বলেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক এই মহাপরিচালক। তিনি বলেন, ফিল্ড মিল্ক পাউডারের আমদানি বাড়ায় এরই মধ্যেই কম দামে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন খামারিরা। কারণ, তরল দুধের চেয়ে নিম্নমানের ও সস্তা দুধের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, সাতক্ষীরা, যশোর, রংপুর প্রভৃতি এলাকার খামারিরা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ২৯ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকায় প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করে থাকেন, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। বিক্রি করতে না পেরে অনেক সময় দুধ ফেলে দিতেও বাধ্য হন খামারিরা।
মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ প্রকল্প (পাঁচ হাজার কোটি টাকার) বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, তখন গুঁড়া দুধের ওপর শুল্ক হ্রাস সরকারের নীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে এই ফিল্ড মিল্ক পাউডার দুধ বিক্রি হয় না। এটি তাদের ডাম্পিং প্রোডাক্ট এবং তারা তা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে বিক্রি করে থাকে। আর আমাদের একশ্রেণির ব্যবসায়ী অতি মুনাফার লোভে এটি আমদানি করে থাকে।’ শাহ এমরান বলেন, ‘এ ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকার কার স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে? এতে মানুষের পুষ্টি হুমকিতে পড়বে, দুধ উৎপাদনকারী খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যেখানে সরকার এই দুধ আমদানি নিরুৎসাহিত করার কথা, সেখানে শুল্ক কমানোয় আমরা বিস্মিত হয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৬৯-এর ১৮(বি) ধারায় বলা আছে ডাম্পিং পণ্য আমদানি করলে তার জন্যও শুল্ক দিতে হবে। তাই শুল্ক হ্রাস নয়, বরং বিদ্যমান ২৫ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখার পাশাপাশি অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপের দাবি করছি আমরা।’
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, ২০১০-১১ সালে দুগ্ধ খামারের সংখ্যা ছিল ৭৯ হাজার ৯৪২টি। বিকাশমান এই খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি এবং মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তার স্বার্থ বিবেচনার জন্য অর্থমন্ত্রীকে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।