হিলি শুল্ক স্টেশনের গুদাম কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ
দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার হিলি শুল্ক স্টেশনের গুদাম কর্মকর্তা নীলরতন বিশ্বাস নিলাম প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে পণ্য পাইয়ে দিতে নিলামের জন্য বড় পণ্য-লট করা হয়েছে। বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন বলে নিলামে অংশ নিতে পারছেন না স্থানীয় শতাধিক ব্যবসায়ীরা। এতে বিপুল রাজস্ব হারাবে সরকার।
শুল্ক স্টেশনের কার্যালয় ও শুল্ক গুদাম কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, হিলি, পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট সীমান্তে বিজিবিসহ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বিভিন্ন সময় ভারতীয় অবৈধ মালামাল আটক করে হিলি শুল্ক গুদামে জমা দেয়। এসব মালামাল সাধারণ নিলাম ডাকের মাধ্যমে বিক্রির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে হিলি শুল্ক গুদাম কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ অবস্থায় গুদাম কর্মকর্তা নীলরতন বিশ্বাস প্রায় ৬২ মেট্রিকটন ভারতীয় জিরা এবং ৬৭৫টি পুরাতন ও নতুন বাইসাইকেল সাধারণ নিলামে বিক্রির জন্য তালিকা প্রস্তুত করে। এর মধ্যে প্যাকেট জিরা ৫৭ মেট্রিকটন ও খোলা জিরা পাঁচ মেট্রিকটন রয়েছে। এসব বিক্রির জন্য ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়। এর আগে গত ১ এপ্রিল কয়েকটি লটে সাধারণ নিলাম দেওয়া হয়।
স্থানীয় ক্ষুদ্র নিলামকারী আতাউর রহমান, ইউনূছ আলী ও শাহাজাহান আকন্দ অভিযোগ করেন, গুদাম কর্মকর্তা নীলরতন বিশ্বাস বগুড়া, দিনাজপুর ও রংপুরের কয়েকজন প্রভাবশালী নিলামকারী ব্যবসায়ীর সঙ্গে নিলাম প্রক্রিয়া প্রস্তুত করার আগেই তাদের নিলামে জিরা ও বাইসাইকেল পাইয়ে দিতে আঁতাত করেছেন। এমনকি তিনি নিলামের সরকারি মূল্য গোপন না রেখেই ওই ব্যবসায়ীদের কাছে তথ্য ফাঁস করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যাতে নিলামে অংশ নিতে না পারে সেজন্য ছোট লট না করে জিরার একটি বড় লট করা হয়েছে। ১৪ অক্টোবর জিরা ও সাইকেলের যে দুটি লট প্রস্তুত করা হয়েছে, তাতে জিরার লটের সম্ভাব্য সরকারি মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর এই মূল্যের ওপর ২৫ শতাংশ ব্যাংকে বিড করতে হবে। এতে ৩০ থেকে ৩১ লাখ টাকার ব্যাপার। সাইকেলের লটের সরকারি সম্ভাব্য মূল্য ধরা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এতে ব্যাংকে বিড করতে লাগবে প্রায় ৪ লাখ টাকা।
ব্যবসায়ীরা আরো বলেন, গুদাম কর্মকর্তা নীলরতন বিশ্বাসের অনিয়মের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে এত টাকা দিয়ে বিড করতে পারবেন না। কারণ এই পরিমাণ টাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেওয়া সম্ভব হবে না। এক বছর আগেও যেসব নিলাম ডাক দেওয়া হয়েছে, তার প্রতিটি লট ছোট আকারে করা হয়েছে। তাতে সব ধরনের নিলামকারী ব্যবসায়ীরা অল্প টাকায় বিড করে নিলাম ডাকে অংশ নিতে পেরেছেন। এবার বড় ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতানোর নকশা এঁটেছেন নীলরতন। তাই আর নিয়মের তোয়াক্কা না করে বড় লট করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, নীলরতন গত বছরের ২৩ আগস্ট শুল্ক গুদামের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একের পর এক অনিয়ম করছেন। সব অন্যায়ের কাছে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার, সুপারসহ ব্যবসায়ীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। তিনি জমাকৃত ভারতীয় শাড়ি, থ্রিপিসসহ বিভিন্ন ধরনের মালামাল চুরি করে বিক্রি করেন। এমনকি বিজিবি ও র্যাব ভারতীয় দামি মালামাল আটক করে গুদামে জমা দেওয়ার পর তিনি বাজার থেকে কমদামে মালামাল এনে পরিবর্তন করে ওই দামি মালামাল কালোবাজারে বিক্রি করেন।
স্থানীয় কাস্টমস কার্যালয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি রংপুর কাস্টমস কমিশনার মো. মুজিবুর রহমানসহ একটি প্রতিনিধিদল হিলি শুল্ক স্টেশন পরিদর্শনে আসেন। এ সময় তাঁরা গুদাম কর্মকর্তার কার্যালয়ের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখতে পান গুদাম কর্মকর্তা প্রায় এক বছর ধরে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের দেওয়া সিজারলিস্ট রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করেননি। পরে তিনি ওই গুদাম কর্মকর্তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিলেও আজ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জয়পুরহাট-৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের এক কর্মকর্তা ক্ষোভের সাথে বলেন, বিজিবি হিলি, জয়পুরহাট, পাঁচবিবি সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ভারতীয় মালামাল আটক করে। এরপর নিয়ম মোতাবেক বিজিবির সদর দপ্তরের বেঁধে দেওয়া মূল্য এবং বর্তমান বাজার মূল্য বিবেচনা করে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে হিলি শুল্ক গুদামে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু গুদাম কর্মকর্তা নীলরতন বিশ্বাস কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কালোবাজারীদের সঙ্গে আঁতাত করে জব্দ তালিকায় (সিজার লিস্ট) মূল্যের অর্ধেকও দাম না ধরেই কম মূল্যে নিলামে এসব পণ্য বিক্রি করেন। এর কারণে সরকার লাখ লাখ টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই গুদাম কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জয়পুরহাট-৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নে একাধিক অভিযোগ রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
বিজিবির ওই কর্মকর্তা আরো জানান, গত ২১ মার্চ কড়িয়া বিওপি ক্যাম্পের সদস্যরা ৪০ কেজি ভারতীয় কচ্ছপের শুটকি আটক করে। গত ৩০ মার্চ প্রতি কেজি শুঁটকির মূল্য ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে হিলি শুল্ক গুদামে জমা দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত নিলামে বিক্রি করা হয়নি। বর্তমানে শুঁটকিগুলির কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে শুঁটকিগুলি কালোবাজারে বিক্রি করা হতে পারে। এতেও সরকার প্রায় আট লাখ টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বিজিবির হিলি সিপি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার আতাহার আলী বলেন, নিলামে জিরা ও সাইকেল বিক্রির বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি বৈঠক করা হয়েছে। সেখানে জিরা ও সাইকেলের মূল্য কম ধরে নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত হলে আমি তাতে আপত্তি জানিয়ে চলে আসি। পরে প্রতি কেজি জিরার মূল্য বা সাইকেল প্রতিটির মূল্য কী নির্ধারণ হয়েছে তা আমি জানি না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গুদাম কর্মকর্তা নীলরতন বিশ্বাস বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জিরার একটি লট করা হয়েছে। এতে কোনো অনিয়ম বা কোনো নিলামকারীকে সুবিধাও দেওয়া হয়নি। ছোট লট করা না করা কর্তৃপক্ষের বিষয়। কচ্ছপের শুঁটকি বিক্রির অভিযোগ সত্য নয়। আগের গুদাম কর্মকর্তারা দায়িত্বে অনিয়ম করায় তার খেসারত আমাকে দিতে হচ্ছে। এসব কারণে কর্তৃপক্ষ নারাজ থাকতে পারে।
এ বিষয়ে হিলি শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশনার মতিউর রহমান বলেন, গুদামের রক্ষিত মালামালের হিসাব-নিকাশ পর্যালোচনা এবং গুদাম কর্মকর্তার বিষয়ে কাস্টমসের একটি প্রিভেনটিভ দল অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এতে অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিলামে কোনো ধরনের অনিয়ম না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। আমি সম্প্রতি এখানে যোগ দিয়েছি। ভুল কিছু হতে পারে। তবে সরকারি রাজস্ব আহরণের স্বার্থে সবার নিলাম ডাকে অংশ নেওয়া দরকার।

জাহিদুল ইসলাম, হিলি