কোরবানির চামড়াও প্রক্রিয়াজাত হবে হাজারীবাগে!
ঈদুল আজহার আগেও হাজারীবাগের সব চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প (ট্যানারি) সাভারের হেমায়েতপুরে শিল্পনগরীতে স্থানান্তর হচ্ছে না। কারণ এরই মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ভবন নিমার্ণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপন আংশিক সম্পন্ন হলেও সেখানে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা বা রপ্তানিযোগ্য করে তোলা সম্ভব নয়। তাই এবারের কোরবানির চামড়াও হাজারীবাগে প্রক্রিয়াজাত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বেশির ভাগ ট্যানারির মালিক।
ট্যানারি স্থানান্তরের অগ্রগতি নিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘এরই মধ্যে বিসিকের শতভাগ প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগের মূল লাইনের কাজও শতভাগ শেষ। এখন ট্যানারির মালিকরা শাখা লাইনের সংযোগ নেবেন। এটা তাঁদের দায়িত্ব।’
ট্যানারির মালিক ও ব্যবসায়ী সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, সারা বছর সংগ্রহ করা মোট চামড়ার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই সংগ্রহ হয় ঈদুল আজহায়। গত বছর কোরবানিতে প্রায় ৫৮ লাখ গরু-মহিষ ও ৩২ লাখ খাসি, বকরি ও ভেড়ার কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এবার তার পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। এসব চামড়া এবারো হাজারীবাগেই প্রক্রিয়াজাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য হাজারীবাগেই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
ট্যানারি স্থানান্তরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশবাদীদের চাপ ও আদালতের রায়ে জরিমানার নির্দেশের পরও সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে স্থাপনা নির্মাণকাজ এগোচ্ছে ডিমেতালে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাজারীবাগে দুই শতাধিক ট্যানারির মধ্যে সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে স্থানান্তর হবে ১৫৫টি ট্যানারি। যেসব প্রতিষ্ঠান সাভারে স্থানান্তর হচ্ছে সেগুলোর ভবন নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপন এত দিনে আংশিক সম্পন্ন হয়েছে।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, চামড়া শিল্পনগরীর জুনের অগ্রগতি প্রতিবেদনে ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে একটি ট্যানারির (রিলায়েন্স ইউনিট-২) কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর নির্মাণকাজ এখানো শেষ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বেঁধে দেওয়া সময়ে ট্যানারি স্থানান্তরে ব্যর্থ হওয়ায় হাজারীবাগে কাযক্রম পরিচালনাকারী ১৫৪টি ট্যানারিকে সাভারে স্থানান্তর না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা জরিমানার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কারখানার মালিকদের আপিলের পর তা কমিয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
সময় বেঁধে দেওয়ার পরও কেন ট্যানারি হাজারীবাগ থেকে সাভারে যাচ্ছে না—এ প্রশ্নের জবাবে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) কার্যনিবাহী সদস্য ও সাবেক সহসভাপতি হাজি ইলিয়াসুর রহমান বাবুল বলেন, ‘একটি ট্যানারিও হাজারীবাগে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে আগ্রহী নয়। কিন্তু আমরা বাধ্য। ট্যানারি স্থানান্তর সময়সাপেক্ষ বিষয়। মন্দার কারণে মালিকদের প্রয়োজনীয় টাকার জোগান নেই। স্থানান্তরের জন্য উপযুক্ত টাইমলাইন দরকার। শুধু পরিবেশবাদীদের চাপে আলটিমেটাম দিলেই ট্যানারি স্থানান্তর সম্ভব নয়। মূলত বিসিকের দুর্বলতার কারণেই এত দিন ট্যানারি স্থানান্তর হয়নি। কারণ যেসব অবকাঠামো দরকার তার নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা সাভারে আরেকটি মরা বুড়িগঙ্গা চাই না।’
গত ১৪ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও অনুমোদন-সংক্রান্ত সভায় শিল্প সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘আসন্ন ঈদুল আজহার পশুর চামড়া সাভারে প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। এবার সর্বশেষ টার্গেট দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরাও সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঈদের পর আর হাজারীবাগে কাজ করতে দেওয়া হবে না। সর্বসম্মতভাবেই এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
এর আগে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ট্যানারি স্থানান্তরে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। নির্ধারিত সময়ে তা না হওয়ায় হাজারীবাগে কাঁচা চামড়ার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। নিষেধাজ্ঞা ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হলেও সময় বেঁধে তা আবারো শিথিল করা হয়।
কোরবানির কাঁচা চামড়া প্রবেশ নিয়ে বিটিএ নেতা ইলিয়াসুর রহমান বলেন, ‘আবারো কাঁচা চামড়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিলে কোরবানির চামড়া কারা কিনবে তা জানা নেই। প্রতিটি চামড়ার দাম হবে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। আর এটা নিশ্চিত যে শতভাগ চামড়া পাচার হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরবানির চামড়া হাজারীবাগে প্রক্রিয়াজাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে ট্যানারির মালিকরা। তবে এর পাশাপাশি তারা সাভারে প্রতিষ্ঠান স্থানান্তুরের কাজও এগিয়ে নিচ্ছে। তবে তার গতি খুবই ধীর। পুরানো কারখানা থেকে প্রতি রাতেই ট্রাক ভর্তি যন্ত্রপাতি হেমায়েতপুরে পাঠানো হচ্ছে। একই সঙ্গে আগের রপ্তানি আদেশের চামড়া হাজারীবাগে প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে।
বিটিএর সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এবার ঈদুল আজহার কোরবানির চামড়া শতভাগ হেমায়েতপুরে প্রক্রিয়াজাত সম্ভব নয়। এরই মধ্যে ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে ৩০-৩৫টি হেমায়েতপুরে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার উপযোগী হয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে তারা সে প্রস্তুতিও নিচ্ছে। বাকি ট্যানারিগুলোর নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বিসিকের প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল কাইয়ুম বলেন ‘চামরা শিল্পনগরীর ট্যানারির বিষাক্ত পানি শোধন করার করার জন্য ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) প্লান্টের দুটি মডিউল চালু আছে। ইটিপি সক্রিয় রাখতে ৪৮টি ট্যানারির বর্জ্যযুক্ত পানি দরকার। কিন্তু তার সরবরাহ নেই। আশা করছি কোরবানির আগে ৩৫টি ট্যানারি হেমায়েতপুরে স্থানান্তর ও কাজ শুরু করবে। ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে ৬৩টির নিমার্ণ কাজ শেষের পথে। তারা চাইলে অল্প সময়ের মধ্যে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করা সম্ভব।’
আবদুল কাইয়ুম আরো বলেন, ‘চামড়া নগরী স্থানান্তরে সরকারের পক্ষ থেকে এখন কোনো ডেডলাইন নেই। ট্যানারি তাড়াতাড়ি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বিসিক আদালতের দিকনির্দেশনা ও রায় অনুসরণ করছে।’
হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে ১৯৮৬ সালে সবচেয়ে বেশি দূষণকারী শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দূষণ বন্ধে ২০০১ সালে উচ্চ আদালত নির্দেশ দেন। ২০০৩ সালের ১৬ অগাস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে এক যুগেও হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি।