সংকটে পোলট্রিশিল্প, বন্ধ হচ্ছে ছোট খামার

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : এনটিভি

গভীর সংকটের মুখে পড়েছে দেশের পোলট্রিশিল্প। লোকসানের মুখে এ শিল্প ছাড়ছেন ছোট খামারিরা। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় ঝুঁকি বাড়ছে বড় উদ্যোক্তাদেরও। উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এখনই সরকার তদারকি না বাড়ালে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বাজার।

গৃহস্থদের বাড়ির আঙিনায় মুরগি লালন-পালনের ধারা পাল্টে আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে গড়ে উঠতে থাকে বাণিজ্যিক খামার। বর্তমানে এ শিল্পে মোট বিনিয়োগ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু ২০০৭ সালে মহামারী বার্ড ফ্লুর কবলে পড়া এ শিল্পে শুরু হয় অস্থিরতা। পুঁজি সংকট, বাচ্চা, খাবার আর ওষুধের দাম বাড়ায় লোকসানের বোঝা নিয়ে খামার গুটিয়ে নেন অনেক প্রান্তিক খামারি; যা এখনো চলছে।

বাড়ছে দাম

একদিন বয়সী বাচ্চার দাম ওঠানামা করছে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ। দুই বছরে পোলট্রি খামারের ওষুধের দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ। দুই বছরে মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ।

এ ব্যাপারে ক্ষুদ্র খামারিদের একজন জানান, পোলট্রি ব্যবসায় তাঁর ৩০-৩৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

ক্ষুদ্র খামারিদের একজন তুলে ধরেন মুরগির বাচ্চার দামের কথা। তিনি জানান, বাচ্চার দাম এখন সবচেয়ে বেশি। প্রতি বাচ্চার দাম পড়ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা।

আর এ ব্যাপারে নজরদারির প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে অন্য এক খামারি বলেন, ‘সরকারের নজরদারি নেই। এ কারণে আমাদের মতো প্রান্তিক চাষিরা মার খাচ্ছে।’ 

অস্বস্তি নিয়ে বাড়ছে উৎপাদন

পরিসংখ্যান বলছে, গত আট বছরে খামারের সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার থেকে নেমে এসেছে ৭০ হাজারের কোটায়। তারপরও বছর বছর বাড়ছে উৎপাদন। গত তিন বছরে মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৫ লাখ, ডিমের দৈনিক উৎপাদন অর্ধকোটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ২০ লাখ পিস। আর পোলট্রি মাংসের উৎপাদন সাড়ে ৩০০ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে সাড়ে ১৮০০ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে।  তবে এই পরিসংখ্যানেও আছে বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তাদের অস্বস্তি। তাঁরা জানালেন, এ শিল্পের ৩০ শতাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ এখন সাতটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পোলট্রিশিল্প সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক মসিউর রহমান বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়েই তারা (বিদেশি প্রতিষ্ঠান) এ দেশে ব্যবসা করছে। তারা অনুমতি নিয়েছে বিনিয়োগ বোর্ড থেকে। আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেই ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে। ওরা বিদেশি ঋণ নিয়ে আসে দুই থেকে তিন শতাংশ সুদে।

মসিউর রহমান আরো বলেন, ‘ওরা এমন একটা পরিকল্পনা করেছে, যা আমরা জানি না। হয়তো এ রকম যে ১০ বছর সবার সঙ্গে মিলিয়ে চলবে, ১০ বছর পর সবাই বসে যাবে, তখন তারা একাই পুরো দেশ চালাবে। তখন তারা যে দাম ঠিক করবে সে দামেই আমাদের খেতে হবে।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘সরকারের নীতিগত সুযোগ-সুবিধা যদি প্রদান করা না হয় তাহলে একটা খারাপ দিন আসবে। তখন ক্রমে ক্রমে আমরা বিদেশি পুঁজির ওপর নির্ভর হয়ে পড়ব। স্বাভাবিকভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেখানে পোলট্রি খাতকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পোলট্রি খাদ্যে ভুর্তকি দেওয়া যেতে পারে। কম সুদে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। সেটা চার থেকে পাঁচ শতাংশে হওয়ার দরকার।’

এমন পরিস্থিতিতে কর অবকাশ সুবিধা বাতিল, কাঁচামাল আমদানি বিশেষ করে সয়ামিলে ১০ শতাংশ, ভুট্টায় ৫ শতাংশ শুল্ক, ৫ শতাংশ উৎসে আয়কর- মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা বলেই মনে করেন উদ্যোক্তা এবং বিশ্লেষকরা।

‘করণীয় ঠিক করছে সরকার’

কর বা শুল্ক যখন ছিল না, তখনো নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম কমাননি জানিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, পোলট্রি খাতে স্থিতিশীলতা আনতে করণীয় ঠিক করছে সরকার।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এদের টিকিয়ে রাখার জন্য এদের কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থায় স্বল্পসুদে ঋণ এবং পোলট্রি খাবারে ভর্তুকি দেওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করছি।’

দেশের জিডিপিতে ২ দশমিক ৪ শতাংশ অবদান রাখা এ শিল্প থেকে জোগান আসে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৪০ শতাংশ। জীবিকা নির্বাহ করছেন প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। ২০২১ সালের মধ্যে চাহিদা পূরণ করতে হলে এ খাতে আরো ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে  মনে করছেন উদ্যোক্তারা।