অবকাঠামো প্রকল্পের চেয়ে গরিবকে স্বস্তি দিতে বেশি মনোযোগী হতে হবে : ড. ওয়াহিদউদ্দিন
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘সারা বিশ্বে মন্দা চলছে। বাংলাদেশকেও অর্থনৈতিক নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন দেশে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ কিংবা প্রবৃদ্ধি অর্জনকে অগ্রাধিকারে না রেখে, আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত—গরিব মানুষ কীভাবে স্বস্তিতে জীবনযাপন করতে পারে, সেদিকে।’
শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সদস্যদের সঙ্গে এক আলোচনায় এসব কথা বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘প্রত্যেকটা দেশকে সময় বুঝে কাজ করতে হয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে আমাদের যতটুকু সম্পদ আছে, তার ব্যবহার কেবল বড় প্রকল্প কিংবা প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক হলে চলবে না। নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ কষ্টে আছে, তাদের জীবনযাপন কীভাবে সহজ করা যায়—সেসব কৌশল ও কর্মসূচি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকতে হবে।’
দক্ষ মানবসম্পদ টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া ভৌত অবকাঠামো দিয়ে কোনো দেশের টেকসই উন্নয়ন হয়েছে, পৃথিবীতে এমন নজির নেই। বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানি ও জাপান দুর্বল অবকাঠামো সত্ত্বেও দক্ষ মানবসম্পদের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল।
‘দক্ষ মানবসম্পদ না থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় দুর্বলতা’ উল্লেখ করে ড. ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, ‘দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে না পারলে, যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো হচ্ছে, সেগুলোর সত্যিকারের সুফল আমরা পাব না।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, ‘বড় বড় প্রকল্পের কারণে দেশে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে কি না, প্রকল্পগুলো কতটুকু রপ্তানিমুখী কিংবা বিনিয়োগকারীরা সহজে পরিষেবা ও জমি বরাদ্দ পাচ্ছে কি না, সেগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।’
যেকোনো উৎস থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন সুদহার আটকে রাখা, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার উন্মুক্ত না করা, রিজার্ভ থেকে ঋণ প্রদানসহ আরও কিছু অর্থনৈতিক পলিসির সমালোচনা করে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘সুদহার, মুদ্রা বিনিময় হার, বাজেট ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সামষ্টিক ও বহিঃঅর্থনীতির ভারসাম্য—সবগুলোকে সমন্বয় করে একটি স্বচ্ছ কৌশলপত্র তৈরি করতে হবে। সেটা না করলে আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়া না-পাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতির কিছু যায়-আসে না। এতে আমাদের লাভ-ক্ষতি কোনোটাই নেই। তবে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে পশ্চিমা দেশ, চীন, ভারত—সবার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। আমাদের কৌশল সেটাই হবে।’
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, এ ধরনের কৌশল গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থেটাকে বড় করে দেখতে হবে। দলীয় স্বার্থ কোনোভাবেই যেন প্রাধান্য না পায়।’
প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কোনো কারণে ব্যবসায়ীরা যদি ধরেই নেয়, পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। তখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন। তাই সরকারের নীতি-কৌশল গ্রহণটা আরও বেশি বাস্তবভিত্তিক হতে হবে।’
‘মূল্যস্ফীতির কারণেই সমাজে বৈষম্য বাড়ছে’ উল্লেখ করে ড. ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, বর্তমানে নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ সবচেয়ে কষ্টে আছে। কারণ তারা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যে কর্মসূচি আছে, সেগুলোর সুবিধা পায় না। এই জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা কর্মসূচি ও নীতিকৌশল গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এখন অর্থনৈতিক সাংবাদিকরা অর্থনীতির দৈনন্দিন নানান বিষয়ে ভালো বিশ্লেষণ করার দক্ষতা অর্জন করেছে।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মৃধা বক্তব্য দেন।