বিশ্ববাজারে কমেছে নিত্যপণ্যের দাম, বাংলাদেশে কমবে কবে?

Looks like you've blocked notifications!
রাজধানীর একটি বাজারে নিত্যপণ্যের দোকান। ফোকাস বাংলার ফাইল ছবি

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি আরও এক দফা বেড়েছে৷ সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে৷ এতে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ পড়ছে৷

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধ আর মন্দার অজুহাত এখন আর চলে না৷ পাশের দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনেছে৷ বিশ্ববাজারে পণ্যের দামও কমেছে, কিন্তু বাংলাদেশে তার চিত্র বিপরীত৷

তাদের কথা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে মূল্যস্ফীতির হিসাব দিচ্ছে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে আরও বেশি৷

১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি

বিবিএস আগস্টের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা আগের জুলাই মাসে ছিল ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ৷ কিন্তু খাদ্যদ্রব্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা জুলাই মাসের তুলনায় ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছে৷ গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার শহরের চেয়ে বেশি৷ গ্রামে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ আর শহরে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ৷ এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশে উঠেছিল৷ এক দশকের মধ্যে গত আগস্ট মাসে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অংকের ঘরে উঠে যায়৷ খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ টাকা মানে হলো ২০২২ সালের আগস্টে যে খাদ্যপণ্য কিনতে ১০০ টাকা লাগত, তা কিনতে এখন লাগছে ১১২.৫৪ টাকা৷ 

তবে জুলাইয়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ থাকলেও আগস্টে কমে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷

সার্বিক মূল্যস্ফীতি অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হার এখন প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করছে৷ জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং জুনে তা ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ৷ তবে গত মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ৷ এই হার ছিল গত প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা বছরভিত্তিক হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ৷

বাংলাদেশে উল্টো চিত্র

করোনার পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে৷ বিশেষ করে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ে সবচেয়ে বেশি৷ আমদানি পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়ে৷ কিন্তু ইতোমধ্যে এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি কমে এলেও বাংলাদেশে চলছে উল্টোচিত্র৷

গত জুলাই মাসে ভারতে মূল্যস্ফীতি গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল৷ ভারতে এখন মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ৷ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া আর সবদেশের মূল্যস্ফীতি কমে আসছে৷ এমনকি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায়ও মূল্যস্ফীতি কমছে৷ বিশ্বব্যাংক বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল ও মালদ্বীপে মূল্যস্ফীতির সূচক নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে৷ বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে৷ কমছে ভোজ্যতেলসহ আরও অনেক ভোগ্যপণ্যের দাম৷ কিন্তু এর মধ্যে যা বাংলাদেশ আমদানি করে তার দামেও কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই৷

‘আর যুদ্ধের অজুহাত চলে না’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে সীমিত আয়ের লোকজন আরও চাপের মুখে পড়ছে৷ খাদ্য কিনতেই তাদের আয়ের বড় অংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে৷ তারা প্রয়োজনীয় খাবার ঠিকমতো কিনতে পারছে না৷’

এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘এখন আর ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত চলে না৷ কারণ আমাদের পাশের দেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি কমে গেছে৷ বিশ্ববাজারে পণ্যের দামও কমছে৷ শুধু আমাদের এখানে উল্টো৷ তা না হলে ডাবের, ডিমের দাম বাড়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না৷ মূল বিষয় হলো অসাধু ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার লোভ৷ তারা ইচ্ছেমতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়৷ আর বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে৷ তাই তারা এখন আরও বেপরোয়া৷ বাণিজ্যমন্ত্রীর কথার পর থেকে দাম আরও বেশি বাড়ছে৷’

এস এম নাজের হোসেন আরও বলেন, ‘বিবিএস যে হিসাব দিচ্ছে তা সরকারকে খুশি করতে৷ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেশি৷ গত বছর আমরা গবেষণা করে দেখিয়েছিলাম মূল্যস্ফীতি ১৭ শতাংশ৷ এবার বাস্তবে তার চেয়েও বেশি হবে৷’

মূল্যস্ফীতির তিন কারণ

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, তিনটি জায়গায় ব্যর্থতার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না৷ এক. সঠিক মুদ্রানীতির অভাব। দুই. সঠিক রাজস্ব নীতির অভাব। তিন. অভ্যন্তরীণ বাজারে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য৷

ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম, ভোগ্যপণ্যেরও দাম কমছে, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে৷ তারপরেও বাংলাদেশে পণ্যের দাম কীভাবে বাড়ে? আমাদের পাশের অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে৷ এটা থেকেই পরিষ্কার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সেভাবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ অথবা যেগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো তেমন কাজে আসেনি৷’

ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্ন আয়ের মানুষ৷ এ বছরও আমরা আমাদের একটি গবেষণায় দেখেছি, নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে৷ তাদের খাদ্যপণ্যে কাটছাঁট করতে হচ্ছে৷ এমনকি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায়ও টান পড়ছে৷’

এসব কথার জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়েছে৷ এর কারণ, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ায় তার প্রভাব সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে৷ গত মাসে বৃষ্টি ও সড়ক যোগাযোগের সমস্যার কারণে ডিম, মুরগি, মাছের দাম বেড়েছে৷ তার প্রভাব পড়েছে৷ আর আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্যের দাম কমেছে তার দাম এখানে বাড়েনি৷ সিন্ডিকেট করেও দাম বাড়ানো হতে পারে৷ তবে সে ব্যাপারে আমার ভালো ধারণা নেই৷’

এম এ মান্নান বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে চাপমুক্ত রাখতে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে৷ বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে৷ গরীব মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত৷ তাই এক কোটি মানুষকে রেশন কার্ড দেওয়া হয়েছে৷ চার কোটি মানুষকে কম দামে নিত্যপণ্য দেওয়া হয়৷ এরপর ফুড ফর ওয়ার্কসহ আরও কিছু কর্মসূচি আছে৷’