বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস ও পূজায় ফুলের বাজার হাজার কোটি টাকার
যেকোনো উৎসবে ফুলই হয়ে উঠেছে এখন প্রধান অনুষঙ্গ। বছরজুড়েই এখন মিলছে নানান প্রজাতির ফুল। ফুল ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০০ কোটি টাকার ফুলের বাজার কয়েক বছরেই হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ফুলের চাষ। দুই-তিনটি জেলা থেকে এখন ফুলের আবাদ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ২৪টি জেলায়।
পাশ্চাত্যের ভালোবাসা দিবস আর বাংলার বসন্ত যেন প্রেমিকযুগল হয়ে আসে একইদিন। আজ বুধবার বসন্তের প্রথম দিন। সঙ্গে ভালোবাসা দিবস (১৪ ফেব্রুয়ারি)। এদিন বাড়তি পাওনা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজা। এ তিনটি উৎসবেই প্রধান অনুষঙ্গ ফুল। একই দিনে তিন উৎসব ঘিরে ফুল বাজারে রমরমা অবস্থা। ব্যস্ত ফুল ব্যবসায়ীরাও। ফুলের দাম বেড়েছে তিনগুণ। এবার রেকর্ড ফুল বিক্রির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি বলছে, রাজধানীতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ১২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে।
ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির অধীনে শাহবাগে দেড় শতাধিক তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী পাইকারি ফুলের বাজারে নেতৃত্ব দেন। আর শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির অধীনে আছে খুচরা ফুল বিক্রির অর্ধশতাধিক দোকান। এ ছাড়া ৩০ থেকে ৩৫টি অস্থায়ী খুচরা দোকান রয়েছে।
ফুলের বাজার এখন কেমন জানতে চাইলে, বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি বাবুল প্রসাদ বলেন, ‘এবার একই দিনে পহেলা ফাল্গুন, সরস্বতী পূজা ও ভালোবাসা দিবস। এ কারণে চাহিদা বেশি থাকায় ফুলের দাম বেড়ে গেছে। দাম বাড়তি হওয়ায় বাণিজ্যের হিসাবও বেড়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঘিরে রাজধানীতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ১২০ কোটি টাকার মতো ফুল বিক্রি হবে বলে আশা করছি। তিন উৎসবের ফুলের চাহিদা এক দিনে পূরণ করা কষ্টকর। সবাই চাইবেন ফুল সংগ্রহ করতে। সেক্ষেত্রে ফুলের দামটাও চড়া থাকবে। বর্তমানে বছরজুড়ে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। আমরা আশা করছি, দু-এক বছরের মধ্যে দেশে ফুলের বাজার দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে।’
ফুলের চাষ ও পেছনের কথা
ফুল ব্যবসায়ীরা বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে এমনিতেই ফুল বিক্রি বেশি হয়। তবে ফুলের দাম এবার তিনগুণ বেড়েছে। ঢাকার বাজারে অধিকাংশ ফুলই আসে যশোরের গদখালী, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়নগঞ্জের বন্দর ও সাভারের গোলাপ গ্রাম থেকে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, চীন ও ভারত থেকেও ফুল আমদানি করা হয়। যেসব ফুল দেশে চাষ হয় না সেগুলোই বিদেশ থেকে আসে।
ঢাকায় ১৯৮৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে ফুল বিক্রি শুরু হয়। তখন বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে ফুল বিক্রি হতো। ১৯৯০ সালে শাহবাগে প্রথম ফুলের বাণিজ্যিক পাইকারি মার্কেট স্থাপিত হয়। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাত এবং সড়কের পাশে ফুল বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এবার পাইকারি পর্যায়ে ফুলের দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারে মানভেদে একটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ৬০ টাকায়। জারবেরা ২০ থেকে ৫০ টাকা, গ্লাডিওলাস ২০ থেকে ৬০ টাকা ও রজনীগন্ধা ৫ থেকে ২০ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। এ ছাড়া ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এক হাজার গাঁদা ফুল। তবে খুচরা বাজারে একই ফুল বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। পাইকারি বাজারে সব ফুলের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা করে বেড়েছে। একটি গোলাপ ৩০ থেকে ৬০ টাকা, একটু বড় সাইজের গোলাপ ৫০ থেকে ১০০ টাকা, জারবেরা ৪০ থেকে ৭০ টাকা, গ্লাডিওলাস ৪০ থেকে ৭০ টাকা ও রজনীগন্ধা প্রতি স্টিক ২০ থেকে ৪০ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে।
শাহবাগের আনিকা পুষ্প বিতানের স্বত্বাধিকারী ও শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আগে মানুষ বিশেষ উৎসবে ফুল কিনতেন। এখন উপলক্ষ ছাড়াও ফুল কেনেন। উৎসব উদযাপনে এখন কোনো গিফট কিনলেও সঙ্গে এক তোড়া ফুল থাকে। ফলে ফুলের ব্যবহার বহুমুখী হয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে আবাদও। বাড়ছে দামও। কারণ চাষিদের খরচ বাড়ছে। আমরা মূলত যশোর থেকে ফুল সংগ্রহ করি। যশোরের ঝিকরগাছায় সবচেয়ে বেশি ফুলের চাষ হয়। ফলে সারা দেশে ফুলের মার্কেট কত, সেটা কিন্তু বলা মুশকিল। তবে এটা যে বাড়ছে সেটা আমরা বলতে পারি। শুধু শাহবাগেই ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনটি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আমরা কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছি।’
পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস ঘিরে জমজমাট ব্যবসা
ফুলের পাইকারি ব্যবসায়ী ইমামুল হোসেন বলেন, ‘তিনটি উপলক্ষ একসঙ্গে হওয়ায় এবার ফুলের চাহিদা অনেক বেশি। আমরা পাইকারি মার্কেটেও চাহিদা অনুযায়ি ফুল পাচ্ছি না। দুদিন আগেও যে গোলাপের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তা মঙ্গলবার কিনেছি ৬০ টাকায়। বুধবার এই গোলাপ ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হতে পারে। সাধারণ একটা ফুলের তোড়া ২৫০ টাকা।’
১৯৯৪ সাল থেকে শাহবাগে ফুল ব্যবসা করেন জামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘তিনটি উৎসব তিন দিনে হলে ব্যবসা আরও ভালো হতো। ফুলের দোকান দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সাধারণত শাহবাগে বড় দোকানে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। আর ছোট দোকানে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হয়। এবার ফুলের বিক্রি খুবই ভালো হচ্ছে। দোকানে ৫০ রকমের ফুল রয়েছে। এর মধ্যে আছে ১৫ ধরনের বিদেশি ফুল।’
অধিকাংশ ক্রেতার অবশ্য অভিযোগ, ফুলের দাম বাড়তি। রফিকুল আলম নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন উপলক্ষে ইতোমধ্যে ফুলের চাহিদা বেড়েছে। সেজন্য ব্যবসায়ীরাও দাম বেশি চাইছেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়। তারা সাধারণ মানুষের চাহিদাকে পুঁজি করে অতিরিক্ত দাম নিচ্ছেন।
শারমিন সুলতানা নামে এক নারী বলেন, অন্য সময়ের চেয়ে ফুলের দাম তিন গুণ বেশি। ভালোবাসা দিবসে ফুলের চাহিদা বেশি হয়ে ওঠে, কারণ এটি ভালোবাসা প্রকাশের উপযুক্ত উপহার। ফুলের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভালোবাসার আনন্দ ও মনোমুগ্ধতা বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা ঠিক এ সুযোগটি নিচ্ছেন।
বাড়ছে ফুলের উৎপাদন
যশোরের নীলকণ্ঠনগর গ্রামের ফুল চাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমি এক একর জমিতে ফুলের চাষ করি। বছরে খরচ বাদে সাত-আট লাখ টাকা আয় হয়। আগে আমরা শুধু কয়েকজন ফুলের চাষ করলেও এখন আমাদের ঝিকরগাছায় মাঠের পর মাঠ ফুল চাষ হচ্ছে। অন্য আবাদ ছেড়ে ফুল চাষ করছেন।’
কেন চাষিরা ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন, জানতে চাইলে ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘প্রথমত এটা অনেক বেশি লাভজনক। আর দ্বিতীয়ত, কোন মৌসুমে একটু লস হলেও পরের মৌসুমে সেটা পুষিয়ে যায়। আর তৃতীয়ত, ফুল প্রতিদিন বিক্রি করা যায়। ধান বা অন্যান্য আবাদ একটা নির্দিষ্ট সময় পর উঠিয়ে বিক্রি করতে হয়। ফুলের ক্ষেত্রে তেমন না। একটি বাগান করলে প্রতিদিনই সেখান থেকে ফুল বিক্রি করা যায়। একেকদিন একেক জাতের ফুল তোলা যায়। ফলে চাষিদের হাতে সব সময় টাকা থাকে।’
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘যশোরের গদখালী ফুলের অন্যতম বড় মার্কেট। আমরাই প্রথম ফুলের যে ব্যবসা হয়, সেটা দেশের মানুষকে শিখিয়েছি। বছরে আমাদের গদখালী আড়তে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। যেভাবে এটা বাড়ছে, তাতে ১০০ কোটিতে পৌঁছতে বেশিদিন লাগবে না। ২০১৯-২০২০ সালের দিকে আমাদের একটা জরিপ হয়েছিল, তখন দেখা গিয়েছিল এক হাজার ২০০ থেকে ৩০০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়েছিল। এখন সেটা আরও অনেক বেড়েছে। সরকারি সহায়তাও এখন অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি পরিবহণও সহজ হয়েছে। দ্রুত আমরা ঢাকায় ফুল পৌঁছতে পারছি। যশোর থেকে এখন ফুল সব জেলাতেই যাচ্ছে। দেখেন, নেদারল্যান্ডসের ৬০ ভাগ রাজস্ব আসে ফুল থেকে। আমরাই চাই, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফুল একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর ফুল চাষের জন্য আমাদের দেশের মাটি-আবহাওয়া অনেকটা ভালো। ফলে দিনদিন এটার বিস্তৃতি বাড়বে।’
ফুল চাষে নতুন করে বিস্তৃতি ঘটেছে নারায়নগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের সাবদি গ্রামে। সেখানকার ফুল চাষি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. জামান হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানে ৮০ হেক্টর জমিতে দুই শতাধিক চাষি বর্তমানে ফুল চাষ করছেন। পাশাপাশি সাবদির আশপাশের দিঘলদি, সেলশারদি, মাধবপাশা ও আইছতলা গ্রামের আরও কয়েক হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ হয়। এছাড়া সোনারগাঁ উপজেলার সম্ভুপুরা ইউনিয়নের কয়েক গ্রামেও আবাদ করেন চাষিরা। এসব গ্রামের বাগানগুলোতে রজনীগন্ধা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, বাগানবিলাস, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, কসমস, দোলনচাঁপা, নয়নতারা, মোরগঝুঁটি, কলাবতি, বেলি, জিপসি, চেরি, কাঠমালতি, আলমন্ডা, জবা, রঙন, টগর ও রক্তজবাসহ ২০ থেকে ২৫ ধরনের ফুল চাষ হয়। তবে এবার অতিরিক্ত শীত ও বৃষ্টির কারণে কিছু ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। ফুলচাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে আমাদের ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ।’
বন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফারহানা সুলতানা জানিয়েছেন, ‘বছরের বারোমাসই বন্দরের কয়েকটি গ্রামে ফুল চাষ করা হয়। পুরো জেলায় ১৫৫ হেক্টরের বেশি জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। বিশেষ দিন ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ফুলের বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ তিনটি দিবসেই প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যস্ততা ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীদের।’