স্পেনে ‘মোস্ট ট্রান্সফরমড স্টুডেন্ট’ মেহেদি হাসান

Looks like you've blocked notifications!
স্পেনে ‘দ্য মোস্ট ট্রান্সফরমড স্টুডেন্ট’ পুরস্কার পেয়েছেন মেহেদি হাসান। ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী রয়েছেন। সেখানে থেকে তাঁরা অর্জন করছেন সম্মানজনক ডিগ্রি। শুধু পড়াশোনা নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা অবদান রাখছেন। দেশের বাইরে বাংলাদেশের মেধাবী মুখ মেহেদি হাসান। স্পেনের বার্সেলোনায় থাকেন তিনি। পড়েন আইইএসসি বিজনেস স্কুলে। সেখানে অর্জন করেছেন শিক্ষার্থীদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘দ্য মোস্ট ট্রান্সফরমড স্টুডেন্ট-২০২০’।

মেহেদি হাসানের গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানার কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামে। তাঁর বাবা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জেলায় বসবাস করেছেন। ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে মেহেদির জন্ম ঢাকার দক্ষিণখানে। বাবা খলিলুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা। মা নিলুফার বেগম গৃহিণী। তাঁর ছোট দুই বোন হাসি ও খুশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেন মেহেদি হাসান। অনার্সে একাডেমিক এক্সসেলেন্সের জন্য পান স্কলারশিপ। মাস্টার্স শেষে তাঁর সুপারভাইজার ও প্রিয় শিক্ষক ড. কামরুল হাসান তাঁকে পিএইচডি করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এতটাই পছন্দ করতেন যে আইটিতে ক্যারিয়ার শুরু করেন।

বড় বড় কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ পান মেহেদি হাসান। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, গ্রামীণফোনের মতো কোম্পানিতে চাকরি করেন ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে। ২০১৭ সালে তিনি গ্রামীণফোনের কনিষ্ঠ ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারদের একজন হন। স্পেনে যাওয়ার আগে তিনি ছিলেন গ্রামীণফোনের ই-কমার্স অ্যান্ড পেমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রধান।

মেহেদির এমবিএ ও স্পেন যাত্রা

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং মেহেদি হাসানের প্যাশন। তাঁর উপলব্ধি হয়, কোম্পানিকে সাহায্য করতে হলে আগে তাঁকে বিজনেস বুঝতে হবে। তাঁর ভাষায়, ‘প্রথমে ভাবলাম আইবিএ থেকে  এক্সিকিউটিভ এমবিএ করব। কিন্তু আরো ইনফরমেশন কালেক্ট করা শুরু করলাম, বিশ্বের বড় ব্যক্তিরা কোথায় এমবিএ করেন, কীভাবে করেন। ফিন্যান্স টাইম থেকে বিশ্বের টপ এমবিএ স্কুল সম্পর্কে খবর নিলাম। তাদের রিক্যুইয়ারমেন্ট, কস্ট, স্কলারশিপ সব কিছু নিয়েই ঘাঁটাঘাটি করলাম। অনেক নতুন নতুন টপ বিজনেস স্কুলের নাম জানলাম, যা আগে কখনো শুনিনি বাংলাদেশে। দেখলাম একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এসব টপ বিজনেস স্কুলে এমবিএ করা প্রায় অসম্ভব। যেমন—হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে সব মিলিয়ে দুই বছরে দুই কোটি টাকা খরচ। তাহলে বড় বড় স্কুল কি শুধু উচ্চবিত্তদের জন্য? দেখলাম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্টুডেন্টরা স্টুডেন্ট লোন নিয়ে পড়ালেখা করে। কম রেটের এই স্টুডেন্ট লোন পেতে হলে রেসিডেন্ট হতে হয়। লোন পেতে কিছু ক্রাইটেরিয়া মিট করতে হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত লোন নিয়ে পড়ালেখা করেছেন।’

মেহেদি আরো বলেন, ‘আমার পক্ষে দুই বছর জব না করে থাকা অসম্ভব ছিল। পড়ালেখার সময় আমার নিজের খরচই বা চালাব কীভাবে। খুঁজতে থাকলাম কোন এমবিএ আমি জবের পাশাপাশি করতে পারব। খরচ, লোন অপর্চুনিটি, ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং সবকিছু মিলিয়ে আবেদন করলাম আইইএসই বিসনেস স্কুল, চান্স পেলাম, স্কলারশিপও পেলাম। স্টুডেন্ট লোনের জন্য আবেদন করলাম, তারপর শুরু হলো আমার আইইএসই এমবিএ যাত্রা।’

আইইএসই বিজনেস স্কুলে ভর্তি

মেহেদি হাসান বলেন, ‘আমাদের দেশে খুব কম মানুষই আইইএসই বিসনেস স্কুলের সঙ্গে পরিচিত। অথচ ফিন্যান্স টাইমের র‍্যাঙ্কিংয়ে আইইএসই ছয় বছর ধরে বিজনেস এক্সিকিউটিভ এডুকেশনের জন্য বিশ্বের প্রথম। ২০১৮ সালে ইকোনমিস্টের  র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী আইইএসই ইউরোপের বেস্ট বিজনেস স্কুল এবং বিশ্বের ছয় নম্বর বিজনেস স্কুল। ৬২ বছর আগে আইইএসই প্রতিষ্ঠিত হয়, কয়েক বছর পরই হার্ভার্ডের অ্যালায়েন্স হিসেবে এমবিএ প্রোগ্রাম ওপেন করে।’

মেহেদির ভাষায়, ‘আইইএসই এমবিএ প্রোগ্রাম হচ্ছে ৮০ শতাংশ কেস স্টাডি মেথড। তাঁদের এমবিএতে সাড়ে তিনশর বেশি কেস স্টাডি করানো হয়েছে। ক্লাস মার্কস পেতে হলে শুধু বুঝলেই হবে না, অন্যকেও বোঝাতে হবে। কোয়ালিটি ক্লাস পার্টিসিপেশন হচ্ছে মূলমন্ত্র। বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে সব সেক্টরেরই কেস স্টাডি আছে। এ ছাড়া পাঁচটি মহাদেশ (চীনের সাংহাই, ইউএসের নিউইয়র্ক, কেনিয়ার নাইরোবি, ব্রাজিলের সাও পাওলো) এক সপ্তাহ করে সশরীরে ক্লাস করতে হয়েছে এবং বিভিন্ন কোম্পানি পরিদর্শন করতে হয়েছে। সবশেষে, বিভিন্ন কোম্পানির রিয়েল কারেন্ট প্রব্লেমের সমাধান নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। প্রতি মাসেই বড় বড় ব্যক্তিত্ব যেমন স্পেনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অব টুইটার, ম্যানেজিং ডিরেক্টর অব মাইক্রোসফট, ম্যানেজিং ডিরেক্টর অব ওরাকল এসে তাঁদের জীবনের গল্প শেয়ার করতেন। তাঁরা কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন, কীভাবে সেগুলো সামলেছেন, ইত্যাদি আলোচনা হতো।’

আইইএসইর ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই বিদেশি। ৫০ হাজার অ্যালুমনি। মেহেদি হাসানের দাবি, আইইএসইর প্রথম বাংলাদেশি শিক্ষার্থী তিনি। শিক্ষার্থীদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘দ্য মোস্ট ট্রান্সফরমড স্টুডেন্ট-২০২০’ জয় করেছেন মেহেদি। আইইএসইতে কীভাবে এমবিএ করা যায়, তার পরামর্শও দিয়েছেন মেহেদি হাসান।

যেভাবে আইইএসইতে এমবিএ করা যায়

মেহেদি জানান, যেকোনো শীর্ষ এমবিএর মতোই আইইএসইতে ভর্তির জন্য জিম্যাট ও আইইএলটিএস ও টোফেল প্রয়োজন। জিম্যাট না থাকলে আইইএসই একটা অ্যাডমিশন টেস্ট নেয়। অ্যাডমিশন ডিরেক্টরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে হয়। এমবিএ ফুল টাইমও করা যায়, কাজের পাশাপাশিও করা যায়। সিলেবাস থেকে শুরু করে শিক্ষক সব একই। ফুল টাইমের সুবিধা হচ্ছে স্কলারশিপ বেশি, সমস্যা হচ্ছে পুরো দুই বছরের খরচ নিজের পকেট থেকে দিতে হয়।

কাজের পাশাপাশি এমবিএ তুলনামূলক কষ্টের, কারণ চাকরির পর প্রতিদিন গড়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা কেস প্রিপারেশনের জন্য দিতে হয়। স্পেনে স্টুডেন্ট লোনের সুবিধা প্রচুর। ২.৪ শতাংশ সুদহারে শতভাগ স্টাডি ফি লোন পাওয়া যায় (থাকা-খাওয়া, ব্যক্তিগত খরচ নিজের)। স্পেনের বার্সেলোনা হচ্ছে আইটি হাব। সেখানে হাজারো কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ার খুঁজছে প্রতিদিন। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য স্পেনে চাকরি তুলনামূলক সহজ।

মেহেদি হাসান জানান, গত দুই বছর তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ও সবচেয়ে ভালো সময় ছিল। তবে আইইএসইতে পড়ার সিদ্ধান্ত তাঁর জীবন বদলে দিয়েছেন। বাংলাদেশের কেউ যদি ভূমধ্যসাগরের তীরে বার্সেলোনায় আইইএসইতে এমবিএ করতে চান, তাহলে তিনি সাহায্য করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন।