বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চ বাণিজ্য, নিম্ন শিক্ষা

Looks like you've blocked notifications!

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়ছেন আবুল হাসান (ছদ্মনাম)। ২০১২ সালে যখন তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তখন টিউশন ফি ছিল প্রতি ক্রেডিট আওয়ার এক হাজার ১০০ টাকা। একটি কোর্সের জন্য তিন ক্রেডিট আওয়ার প্রয়োজন। সে হিসাবে একটি কোর্সের পেছনে খরচ পড়ে তিন হাজার ৩০০ টাকা।

২০১৫ সালে ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষার্থীদের দিতে হচ্ছে প্রতি ক্রেডিট আওয়ার দুই হাজার ৩০০ টাকা করে। সে হিসাবে এখন যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের দিতে হবে প্রতি কোর্সের জন্য ছয় হাজার ৯০০ টাকা। আবুল হাসান জানালেন, টাকার পরিবর্তনটাই চোখে পড়েছে, সুযোগ-সুবিধা সব আগের মতোই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি পঠিত বিষয় ব্যবসায় প্রশাসন, যা বিবিএ নামে পরিচিত। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে চার বছরের বিবিএ কোর্স শেষ করেছেন নওশাবা হাসান। তিনি দিয়েছেন চার হাজার ১০০ টাকা করে প্রতি ক্রেডিট। প্রতি কোর্সের জন্য নওশাবার খরচ পড়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে খরচ পড়ছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা প্রতি ক্রেডিটে। অর্থাৎ প্রতি কোর্সের পেছনে খরচ পড়ছে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা।   

অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ার আইন থাকলেও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় চালানো হয় লাভজনকভাবে। বেশি বেশি মুনাফার জন্য প্রতি বছরই বাড়ানো হয় টিউশন ফিসহ শিক্ষা ব্যয়। এমনও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে লেখাপড়া করতে গেলে বিদেশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। এভাবে আইন লঙ্ঘন করা হলেও এ বিষয়ে নেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।

অথচ দেশে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ ও সম্প্রসারণ, সর্বসাধারণের জন্য উচ্চশিক্ষা সুলভকরণ এবং এর মাধ্যমে দাতা জনগোষ্ঠী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২-এ এমন কথাই বলা হয়েছে। আইনে বলা হয়, যেহেতু দেশের কতিপয় জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, ব্যক্তি-গোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট ও প্রতিষ্ঠান বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করিতে আগ্রহী, তাই এর জন্য কিছু বিধান তৈরি করতেই এই আইন প্রণয়ন করা হয়।

তবে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই গড়ে ওঠে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৮৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কমিশনের এক তথ্য অনুযায়ী জানা যায় ২০১৩ সালে প্রায় ৪৯ হাজার ১৮০ জন শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করে।

 

আয় বেশি, শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় কম

২০১৪ সালে ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের বেসরকারি ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয় (তখন ৬০টিই ছিল, বর্তমানে ৮৪টি) ২০১২ সালে মোট আয় করেছে এক হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গড় আয়ের পরিমাণ ৩১ কোটি টাকার বেশি।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে ৩১ কোটি টাকা গড়ে আয় করলেও শিক্ষার্থীদের পেছনে এর অর্ধেকও ব্যয় করা হয়নি। ওই বছর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করেছেন গড়ে মাত্র ৮৭ হাজার ২৬৬ টাকা। তবে এটা গড় হিসাব। বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে এই খরচের হার আরো শোচনীয়।

২০১২ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি সর্বোচ্চ মাথাপিছু ব্যয় করেছে চট্টগ্রামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএসটিসি)। এর পরিমাণ পাঁচ লাখ ৪৩ হাজার ৬০৯ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। এ প্রতিষ্ঠানের মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ দুই লাখ ৭৬ হাজার ৯৬৩ টাকা। তৃতীয় অবস্থানে আছে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, এ প্রতিষ্ঠানের মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ এক লাখ ৮১ হাজার ৯৫ টাকা ও চতুর্থ অবস্থানে আছে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, এ প্রতিষ্ঠানের মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ এক লাখ ৪৮ হাজার ৬৫২ টাকা। আর শিক্ষার্থীপ্রতি সর্বনিম্ন ব্যয় করেছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি। যার পরিমাণ মাত্র নয় হাজার ৩৫৮ টাকা।

আইন অনুযায়ী ‘নো লস নো প্রফিট’ বা ‘লাভও নয় ক্ষতিও নয়’ নীতিতে চলার কথা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অর্থাৎ যে হারে আয় করেছে নিয়ম অনুযায়ী সেই হারেই ব্যয় করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এ কারণে গবেষণাসহ মানসম্মত শিক্ষার পেছনে তাদের ব্যয় অত্যন্ত নগণ্য। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা, জার্নাল ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যয় করেছে খুবই কম। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরির পেছনে ব্যয় করেছে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। আর গবেষণা খাতে এই ব্যয়ের পরিমাণ ৯১ লাখ টাকা।

বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় বাড়ানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও অন্যান্য ফি। এ ছাড়া নানা নামে নানা খাতে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, নিজস্ব ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, তা নিয়ে একটি মানসিক যন্ত্রণা তো আছেই। ভাড়া করা ভবনে ক্লাস হলে বোঝাই যায় সুযোগ-সুবিধা অনেক কম পাচ্ছি আমরা। ভর্তি হওয়ার আগে এসব বোঝা যায় না। কিন্তু ভর্তির পর বোঝা যায় কোথায় এসে পড়েছি। তখন টাকা গোনা আর অনুশোচনা করা ছাড়া আর কিছু থাকে না।’

একাধিক শিক্ষার্থী প্রশ্ন তুলেছেন নিজেদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মান নিয়েও।  

 

ভাড়া করা শিক্ষক দিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ৬০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বমোট শিক্ষকসংখ্যা ১২ হাজার ১১৩ জন। এর মধ্যে পূর্ণকালীন শিক্ষক আট হাজার ১৭৮ ও খণ্ডকালীন তিন হাজার ৯৩৫ জন। পূর্ণকালীন অধ্যাপকের সংখ্যা ৬২৩ ও খণ্ডকালীন এক হাজার ৬৬ জন। পূর্ণকালীন সহযোগী অধ্যাপক ৪২১ ও খণ্ডকালীন ৬০৫ জন। পূর্ণকালীন সহকারী অধ্যাপক এক হাজার ৫০৮ ও খণ্ডকালীন ৭৫৭ জন। পূর্ণকালীন লেকচারার পাঁচ হাজার ২৬৮ ও খণ্ডকালীন এক হাজার ২৭৪ জন। এতে দেখা যায় শিক্ষকদের মধ্যে পূর্ণকালীন শিক্ষকের তালিকাজুড়েই রয়েছে লেকচারার বা প্রভাষকদের আধিপত্য।

কিন্তু ন্যূনতম শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিমাণ শিক্ষক থাকার কথা, এর সিকিভাগও এসব প্রতিষ্ঠানে নেই। অনিয়মিত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা শিক্ষক দিয়েই চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান।

৮৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ে চারটি করে ফ্যাকাল্টি রয়েছে। এসব ফ্যাকাল্টিতে বিভাগ রয়েছে ছয় থেকে ২০টি। একটি বিভাগ পরিচালনার জন্য ন্যূনতম একজন অধ্যাপক, তিনজন সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক এবং চারজন প্রভাষক বা লেকচারার প্রয়োজন। প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকের সিকিভাগের জোগান নেই বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী খণ্ডকালীন বা ভাড়ায় আনা শিক্ষকদের সংখ্যা সার্বক্ষণিক শিক্ষকের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্নতা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা অনুযায়ী, কাগজে-কলমে কোটা পূরণ দেখালেও বাস্তবে এসব শিক্ষকের উপস্থিতি নেই। পূর্ণকালীন শিক্ষকের চেয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এ ছাড়া শিক্ষকরা ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত দেখানোর জন্য অবৈধভাবে অনেক নামি শিক্ষকের নাম ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। কম যোগ্য ব্যক্তিকে করা হয় বিভাগের প্রধান।

নিয়মানুযায়ী একজন শিক্ষক দুটির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে পারেন না। কিন্তু এই নিয়মেরও তোয়াক্কা করছেন না শিক্ষকরা। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক শিক্ষককেই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে দেখা যায়।

 

মান নিয়ন্ত্রণে মন নেই ইউজিসির

দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করার কথা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)। সেই লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত এক চুক্তির মাধ্যমে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ)। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় দুই হাজার ৫৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে গত বছর পর্যন্ত মাত্র দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ প্রকল্প থেকে কাজ করা হয়েছে।

চলতি বছর আরো কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ প্রকল্পের আওতায় এসেছে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়লেও ইউজিসি সেদিকে নজর না দিয়ে হেকেপের টাকার অপব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন সেখানকার শিক্ষার্থীরা। তাঁরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সবই এখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কাজেই মুনাফার যত রকম কায়দা আছে, তার সব ব্যবহার করছে তারা। এখানে শিক্ষার মানের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লাভটা বেশি দেখা হয়। এসবের ওপর অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। তবে সম্প্রতি আমরা একটা নতুন শক্তির পরিচয় পেলাম। সেটা হলো ছাত্ররা। আন্দোলনের মাধ্যমে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করতে সরকাকে বাধ্য করল। অন্য কোনো সময় তারা ঐক্যবদ্ধ না হতে পারলেও এরা ভ্যাটের সময় ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে। এটাও একটা বিরাট বিষয়। তবে এভাবে যদি তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারত, তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত বলে আমি মনে করে। আমার মনে হয় প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র সংসদ থাকা উচিত। যেখানে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা তাদের দাবি-দাওয়া কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারত। এমনকি নিজেদের সমস্যা নিয়ে নিজেরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চাপ দিতে পারত। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানও অনেক উন্নত হতো।’

বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ‘আমার মনে হয়, ছাত্র সংসদ একটা ভালো উপায়। ছাত্র সংসদই সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য কঠোর কোনো নীতিমালা ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন কি না তা জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘নীতিমালা দিয়ে কোনো কাজ হবে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো তো মুখে বলে যে তারা কোনো মুনাফা নেয় না। কিন্তু তারা ট্রাস্টি বোর্ডের যে প্রতিটি সভা করে সেখানে শুনলাম যে একবার বৈঠক করলে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। তো মুনাফা তো তারা ঠিকই নিচ্ছে। যাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করেন, তাঁরা সবাই সমাজে প্রভাবশালী। দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েই এঁরা হয়তো এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়েছেন। তো এঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার শক্তি তো নেই কারো। এঁদের আইনের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ তারা বলবে আমরা তো কোনো মুনাফা নেই না।’

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন নির্ধারণের একটা নীতিমালা থাকা উচিত বলে মনে করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেতন নির্ধারণের একটা নীতি থাকতে হবে। সেটা ইউজিসি কর্তৃপক্ষ বেঁধে দেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান দেখে। তারা শিক্ষার্থীদের কী কী সুবিধা দিচ্ছে সেটা বিবেচনা করেও বেতন নির্ধারণ করা হবে। একটা উচ্চসীমা বেঁধে দিতে হবে যে এর ওপরে বেতন নেওয়া যাবে না। এই নিয়ন্ত্রণটা তো ইউজিসি করতেই পারে। আর যদি আইনে না থাকে, তাহলে আইন সংশোধন করতে হবে। আইন সংশোধন করা তো অসম্ভব কোনো ব্যাপার না।’

 

‘সবই জানি, কিছু করার নাই’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হাতে কোনো ক্ষমতা নেই বলে জানালেন ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মোহাব্বত খান। তিনি এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আমরা সবই জানি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় যে সার্টিফিকেট বিক্রি করে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান ভালো না, টিউশন ফি বেশি নেয়। কিন্তু আমাদের আসলে কিছু করার নেই। কারণ ইউজিসির হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। সেই ক্ষমতা ইউজিসিকে দেওয়াই হয়নি।’

যে আইনবলে ইউজিসি পরিচালিত হয়, সেখানে সংস্থাটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বলে জানান মোহাব্বত খান। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতা না থাকার ফলে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১০ সালের অধ্যাদেশ মানছে না তাদের বিরুদ্ধে আমরা কোনো ইফেকটিভ ব্যবস্থাই নিতে পারছি না। আমরা কিছুই করতে পারি না। যাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করি, বিভিন্ন অনিয়মের খবর পাই। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলেই তারা আদালতের দারস্থ হয়। আদালত থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে এসে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। এসব কথা সরকারকে বারবার বলা হয়েছে। পুরো বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানে। কিন্তু তারপরেও কিছু হচ্ছে না।’

মোহাব্বত খান বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গতিশীলতা আনতে ও এর মান নিয়ন্ত্রণে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর করতে হবে। সেই সঙ্গে ইউজিসির ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এসব প্রস্তাব তিন বছর আগেই সরকারকে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান এই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে মোহাব্বত খান বলেন, ‘ শিক্ষা খাতে ভ্যাট আরোপের তো কোনো মানে হয় না। শিক্ষা তো কোনো পণ্য না। তবে ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে দাবি আদায় করতে গেছে, সেটা খারাপ হয়েছে। কারণ তারা বুঝে গেল যে চাপ সৃষ্টির জন্য পথে নামা যায়। এটা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ হলো। তবে আমার মনে হয় এর পেছনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাঁরা পরিচালনা করেন, তাদের একটা অবস্থান ছিল। কারণ এই আন্দোলন চলাকালে একবারও শুনিনি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে জনগণকে জিম্মি করে আন্দোলনের কোনো অর্থ হয় না। জনগণের তো কোনো দোষ নেই।’