বর্ষবরণে শেষ মুহূর্তে তুলির আঁচড়
বছরজুড়ে সাফল্য-ব্যর্থতা, নাগরিক জীবনের শত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ইতিহাস রচনা করে চোখের পলকে বিদায় নিচ্ছে ১৪২২ বঙ্গাব্দ। আর নতুন বছরকে বরণ করে নিতে শেষ মুহূর্তের কর্মযজ্ঞ চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
চারুকলা, কলাভবন, মল চত্বর, ভিসি চত্বর, হাকিম চত্বর, বাণিজ্য অনুষদের আশপাশ, রেজিস্ট্রার ভবন প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখলে মনে হয় যেন এক টুকরো ‘লাল-সবুজের বাংলাদেশ’।
বাংলা পঞ্জিকার পাতায় চৈত্রের মাত্র এক দিন বাকি। রাত পোহালেই বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার মধ্য দিয়ে উল্লাসে মাতবে কোটি বাঙালি। পুরনো সব জীর্ণতা, গ্লানি-ভেদাভেদ ভুলে নতুনকে আহ্বান করে গোটা জাতি।
বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপ ফুটে ওঠে এ উৎসবের মাধ্যমে। ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’- এ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বৈশাখী আমেজে প্রস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস। চারুকলা ইনস্টিটিউট গ্রহণ করেছে ব্যাপক প্রস্তুতি। শেষ বেলায় তুলির আঁচড়ে রাঙিয়ে তোলা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার মোটিফগুলো।
এরপর রয়েছে কলা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা, গবেষণাসহ বিভিন্ন অনুষদ এবং প্রায় সব বিভাগের ছোট-বড় অনুষ্ঠান। মল চত্বর, মুহসীন হলের মাঠে, কলাভবনের সামনে রয়েছে সংগীত অনুষ্ঠান।
‘এসো হে বৈশাখ’ গানে বর্ষবরণ করবে সঙ্গীত বিভাগ। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাংলার চিরায়ত গান’। আদি থেকে এ যাবৎ বাংলার লোকগানের যে বিবর্তন-বিকাশ গানে গানে তাই চিত্রিত করবেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কলাভবনের সামনে সঙ্গীত বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। এবার বর্ষবরণে নতুন ধারা চালু করতে যাচ্ছে এ বিভাগ। পান্তার সঙ্গে ইলিশের পরিবর্তে পুঁটি মাছের প্রচলন। সঙ্গে থাকছে বেগুন, আলু, শুঁটকি, লইট্টাসহ পাঁচ ধরনের ভর্তা এবং মরিচ-পেঁয়াজ।
সঙ্গীত বিভাগের চতুর্থ বিভাগের শিক্ষার্থী আবু রায়হান বলেন, এখন থেকে ‘পান্তা-পুঁটি’ হয়ে উঠুক বৈশাখী খাবার। ইলিশ কেনার সাধ্য সবার থাকে না। তা ছাড়া গ্রামের কৃষক ইলিশ পায় না। তারা সকালে উঠে পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে এক গামলা পান্তা ভাত খেয়ে কাজে চলে যায়। আমরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ইলিশকে বাণিজ্যিকীকরণ করছি।
নতুন বছরকে বরণ করতে বাংলা বিভাগের এবারো রয়েছে নানা আয়োজন। শুরুতেই ‘এসো হে বৈশাখ’ গান দিয়ে বরণ করে নেওয়া হবে নতুন বছরকে। এরপর হবে অনুষ্ঠান উদ্বোধন এবং বক্তৃতা। থাকবে বাঙালিয়ানা গান, নৃত্য ও অভিনয়। কলাভবনের সামনের জায়গায় অনুষ্ঠান চলবে দুপুর পর্যন্ত। আজ সন্ধ্যায় চৈত্র সংক্রান্তি পালন করবে বাংলা বিভাগ। বরাবরের মতো মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়েই বাংলা সনের শেষ মাস চৈত্রকে বিদায় জানিয়ে নতুন দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনবেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
১৪২৩ বর্ষবরণে থিয়েটার বিভাগের রয়েছে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। প্রথমেই বিভাগের শিক্ষার্থীরা একটি দেয়ালিকা প্রকাশ করছেন। সকাল ৯টায় ‘এসো হে বৈশাখ গান’ গেয়ে বর্ষবরণ করবেন শিক্ষার্থীরা। এরপর হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হবে গান, নৃত্য, অভিনয় ও থিয়েটার বিভাগের নিজস্ব পরিবেশনা।
বর্ষবরণে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় আয়োজনটি হচ্ছে চারুকলা অনুষদের। ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানাতে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকবে ৯টি ভাস্কর্য। এর মধ্যে বিশাল আকৃতির একটি কাঠামোয় দেখা যাবে একজন ‘মা’ পরম যত্নে তার দুই হাত দিয়ে শূন্যে তুলে ধরে আছেন স্নেহের শিশুকে, যা প্রকাশ করছে মা ও সন্তানের মধ্যকার চিরায়ত মধুর সম্পর্ক।
আরেকটি ভাস্কর্য ‘পাখি এবং একটি গাছ সঙ্গে একটি ফুলের সমন্বয়’, যা দ্বারা সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের অপরূপ রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। থাকছে জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক ‘হাতি’। আর থাকবে ‘নৌকা’ প্রতীক, যে প্রতীক সামনে রেখে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া নৌকা এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত। ‘হরিণ’ ভাস্কর্যটি দিয়ে সুন্দরবনকে তুলে ধরা হচ্ছে। আর একটি ঐতিহ্য হলো ‘মাটির তৈরি ঘোড়া’। এ ছাড়া ‘ষাঁড়ের’ ভাস্কর্যটি দিয়ে জঙ্গিবাদসহ সব অপশক্তির মুখোশ উন্মোচন, যারা এ দেশের সম্মানহানি করতে চায় তাদের প্রতিবাদস্বরূপ এটি তৈরি। মঙ্গল শোভাযাত্রায় এভাবে প্রতিটি নিদর্শন বাঙালি জাতির একেকটি ঐতিহ্যকে প্রদর্শন করবে আর অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং অশুভকে নির্মূল এবং মঙ্গলের আগমনকে স্বাগত জানাবে।
এর বাইরেও থাকছে সরা পেইন্টিং, মুখোশ পেইন্টিং, ময়ূরসহ ছোট ছোট পাখির নিদর্শন, হাতে ধরা মুখোশের মধ্যে দু-একটি বাঘ ও পেঁচার মুখোশ। দেশের স্বনামধন্য শিল্পীদের নিয়ে একটি ‘আর্ট ক্যাম্পের’ আয়োজন রয়েছে। বৈশাখী মেলাও থাকছে, যেখানে রয়েছে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, গান, নৃত্য, যাত্রাপালা।
সরাচিত্র সৃজন, কাগজ কেটে নানান প্রক্রিয়ায় নির্মিত মুখোশ, কাগজের ম্যাশের মুখোশ, জলরঙে চিত্রকর্ম সৃজন ও শোভাযাত্রার মূল অনুষঙ্গ কাঠামো নির্মাণ এই পাঁচটি ভাগে প্রায় ৫০০-৬০০ শিক্ষার্থী যুক্ত রয়েছেন এ মহাযজ্ঞে। জানালেন ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মামুন হাওলাদার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, এবারে মূল অনুষঙ্গ হিসেবে রাখা হয়েছে মা ও শিশু। সামাজিক রীতি অনুযায়ী মা ও শিশুর সম্পর্কটি অনেকটা মধুর হয়। তবে বর্তমানে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সেটি এখন আর আগের মতো দেখা যায় না।
একইসঙ্গে অত্যাধিক হারে শিশু নির্যাতন বেড়ে গেছে। যা আমাদের জন্য আশঙ্কাজনক। মূলত এসব বিষয় সামনে রেখেই এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতিপর্ব চলছে। আর সবই হবে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির আলোকে।
নিসার হোসেন বলেন, আমাদের এ মহান আয়োজনে কারো কাছ থেকে কোনো স্পন্সর নিই না। যার কারণে শিক্ষার্থীরা রাত-দিন পরিশ্রম করে বিভিন্ন কারুকার্য করে থাকে। আর সেগুলো বিক্রির অর্থ দিয়ে বাঙালির এ মহান উৎসবের আয়োজন করা হয়।