বায়ান্ন থেকে একাত্তরের ইতিহাসে সমৃদ্ধ রাবির ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’

Looks like you've blocked notifications!

ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের বজ্রকণ্ঠে যখন ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল তৎকালীন পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রতিটি রাজপথ। ঠিক সেই সময় থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরে ‘জয় বাংলা’বলে ঝাঁপিয়ে পড়া মুক্তিকামী বাঙালিদের লড়াইয়ের গল্প আজ নতুন প্রজন্মের অনেকেরই অজানা। গৌরবোজ্জ্বল এই ইতিহাস জানাতে হাজারো স্মৃতি সংরক্ষণ করেছে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’।

ঊনসত্তরের গণবিক্ষোভ। শিক্ষার্থীদের হুংকারে লেজগুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী। পেছন থেকে তাড়া করে অনবরত ইটপাটকেল ছুড়ছে বাঙালি সূর্য সন্তানরা। রাবি শিক্ষকদের মিছিলের অগ্রভাগে শহীদ শামসুজ্জোহা। তার পাশেই রয়েছে হাসপাতালের কফিনে শায়িত ড. জোহার ছবি। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের নানান কৌশলী আক্রমণে পরাস্ত হয়েছে পাকসেনারা, দলবল নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে বাঙালিদের কাছে। এমন অসংখ্য চিত্রকল্প খুব যত্নসহকারে প্রদর্শন করা হয়েছে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার বিভিন্ন গ্যালারিতে।

অন্য একটি গ্যালারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলায় আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের করুণ চিত্র, কিশোরদের ওপর নির্যাতন, গণঅভ্যুত্থানের গণআন্দোলন থেকে বাঙালিদের বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া, দেশের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া অজ্ঞাতনামা শহীদের হাঁড়-গোড় সংরক্ষিত হয়েছে এই সংগ্রহশালায়। এছাড়া আরও রয়েছে প্রখ্যাতশিল্পী মোস্তফা মনোয়ারের শিল্পকর্ম, সুজা হায়দারের বর্ণমালা, আবু তাহেরের অসহায় আত্মা, উত্তম দে’র কোলাজ ‘মুক্তিযোদ্ধার শার্ট’ও প্রণব দাসের ভাস্কর্য ‘আর্তনাদ’।

এছাড়া বাঙালিদের ওপর নির্মম নির্যাতনে ব্যবহৃত পাকিস্তানিদের ছুরি, বুলেট, রকেট লঞ্চার, বিধ্বংসী মাইন ও বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে আনা গণহত্যার হৃদয়বিদারক দৃশ্য ফুটে উঠেছে এখানে। দেশের এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক বহু স্মৃতিকে ধারণ করে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এ জাদুঘর। আরও রয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তির আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন চিত্রকর্ম, দলিল-দস্তাবেজ, আলোকচিত্র, জামা, জুব্বা, কোট, ঘড়ি, পোশাক, টুপি, কলমসহ অসংখ্য দুর্লভ সংগ্রহ। সেই সময়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সংগ্রহ আরও সমৃদ্ধ করেছে ছোট এই জাদুঘরকে। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা গবেষণা করতে চান তাদের কাছে এটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা পাঠাগার।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটে নেমে সামনে তাকালেই দেখা যাবে প্রশাসনিক ভবন। প্রশাসন ভবন থেকে সোজা পূর্ব দিকে প্যারিস রোডের শেষ মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে অবস্থিত দেশের সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’। যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী সংগ্রহশালাটি। যা এখন দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবেও পরিচিত। এটি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর এখানে নিয়মিত দর্শন করতে আসেন শতাধিক দর্শনার্থী। শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা ও শহীদ মিনার কমপ্লেক্স সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন সেই কমিটির সভাপতি।

ছয় হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় মোট তিনটি গ্যালারি রয়েছে। পাশাপাশি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্য আরও একটি গ্যালারি নির্মাণাধীন। তবে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে সংগ্রহশালাটি যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এটি মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায়ের নির্মিত শহীদ মিনারের মুক্তমঞ্চের গ্রিন রুমেই গড়ে ওঠে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রহশালাটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তবে নির্ধারিত স্থান না থাকায় বছরের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এটা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হতো। পরে ১৯৮৯ সালের ২২ মার্চ রাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ আহমদ সংগ্রহশালার মূল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

তিনটি গ্যালারি মিলিয়ে বর্তমানে এতে মোট ৭৫০টি প্রদর্শনী রয়েছে। প্রথম গ্যালারিতে ৫৯টি আলোকচিত্র, ছয়টি প্রতিকৃতি, দুটি কোলাজ, আটটি শিল্পকর্ম, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু সাতটি, ভাস্কর্য একটি, ডায়েরি ও অন্যান্য পাণ্ডুলিপি চারটি এবং বাঁধাইকৃত দুটি আলোকচিত্র রয়েছে। দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১০৮টি আলোকচিত্র, ৩৫টি প্রতিকৃতি, নয়টি শিল্পকর্ম, ১৯টি বাঁধাইকরা আলোকচিত্র, তিনটি ভাস্কর্য, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৯৯টি ও পাঁচটি ডায়েরি। তৃতীয় গ্যালারিতে আছে ১১২টি আলোকচিত্র. একটি প্রতিকৃতি, ১১টি শিল্পকর্ম, একটি বাঁধাই করা আলোকচিত্র, ছয়টি ভাস্কর্য, ৪০টি ডায়েরি-পাণ্ডুলিপি, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৫৬টি।

এছাড়া স্বাধীনতাযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার, ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, জাতীয় চার নেতা এবং রাবির শহীদ শিক্ষকদের প্রতিকৃতি; বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ; স্বাধীনতার ঘোষণা-বাণীর প্রতিলিপি, মুজিবনগরে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র, ঢাকার রাজপথ, ’৭১-র গণবিক্ষোভ, সংগ্রামী জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ, ’৭১-র ছাত্রী নিগ্রহ, ধর্ষিত মাতা-জায়া, গণহত্যা, ২৫ মার্চ ঢাকার রাজপথ; পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলের চুক্তিপত্র, মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোস্টার, শিল্পীদের আঁকা ছবি, ভাস্কর্য, শহীদদের পোশাক ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র; অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান চৌধুরী এবং সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপি; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজশাহীর শহীদদের বিভিন্ন আলোকচিত্র। পরবর্তীতে এ সংগ্রহশালায় আরও অর্ধশতাধিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন আলোকচিত্র সংরক্ষণ করা হয়।

টাঙ্গাইল থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী তানজিনা ইসলাম অথৈ বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই অজানা। এখানে সেসব ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এই সংগ্রহশালা থেকে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি।’

দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এত সুন্দরভাবে দেশের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে তা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতিহাস সংরক্ষণের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেটি সত্যিই প্রশংসনীয়। এখান থেকে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছুই জানতে ও শিখতে পারবে।

শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার কিউরেটর ড. মো. শফিকুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পূর্বে আমাদের যে সংগ্রহ ছিল এখনও তা রয়েছে। নতুন কোনো সংগ্রহ সংযোজন করা হয়নি। তবে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্য নতুন আরেকটি গ্যালারির কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিদিন এখানে শত শত দর্শনার্থী এলেও বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে তাদের চাপ বেড়ে যায়। এছাড়া রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় শিক্ষাসফরে আসে।

ড. শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া শহীদদের নিদর্শন সংগ্রহ করে থাকি। কেউ খবর দিলে আমরা সেখানে ছুটে যাই। তবে সেটা অবশ্যই সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সংগ্রহ করি। ভবিষ্যতেও আমাদের এ নিদর্শন সংগ্রহ অব্যাহত থাকবে।’