ওয়াল্ট ডিজনি ও মিকি মাউসের কথা
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/12/15/photo-1481787950.jpg)
তিনি ছিলেন পৃথিবীর প্রথম অ্যানিমেশন প্রোগ্রামার। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী আর সফল প্রযুক্তিক ভাবনার অধিকারী। একই সঙ্গে একজন মার্কিন চলচ্চিত্র প্রযোজক, নির্দেশক, কাহিনীকার, নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী ও অ্যানিমেটর। তিনি ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি, ওয়াল্ট ডিজনি নামে যিনি সুপরিচিত। স্বপ্নবাজ এই মানুষটির সেই বিখ্যাত উক্তি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, ‘If you can dream it, you can do it।’
১৯০১ সালে শিকাগো শহরে ওয়াল্ট ডিজনির জন্ম। তিনি ছিলেন কাঠমিস্ত্রি এলিয়াস ডিজনি ও তাঁর স্ত্রী ফ্লোরা ডিজনির চতুর্থ সন্তান। ছোট্ট বয়সেই বাবার ফার্মে কাজ করার ফাঁকে ফার্মের পশুদের স্কেচ বানাতে শুরু করেন ওয়াল্ট। আট বছর পরই বিক্রি করে দেওয়া হয় ফার্মটি। তখন কানসাসে সংবাদপত্র সরবরাহ করার একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয় ডিজনি পরিবার। সে সময় ওয়াল্ট ও তার বড় ভাই রয় দুজন মিলে ভোরে উঠে পত্রিকা বিলি করতেন। এর পর যেতেন স্কুলে। সেই বেন্টন গ্রামার স্কুলেই প্রথম প্রতিভার ঝলক দেখান ওয়াল্ট। একদিন আর্ট ক্লাসে ফুল হাতে মানুষের মুখের অবয়বের হুবহু স্কেচ করে শিক্ষককে চমকে দিয়েছিলেন তিনি।
স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে শিকাগো একাডেমি অব ফাইন আর্টসে ভর্তি হন ওয়াল্ট। পড়ার খরচ মেটানোর জন্য তখন তিনি কাজ করতেন বাবার কারখানায় জেলির বোতল পরিষ্কার করার কাজ। এভাবেই সময় পার হতে থাকে। শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সে সময় রেড ক্রসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ফ্রান্স ও জার্মানিতে কাজ করার সুযোগ পান তিনি।
১০ মাস ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ করে ১৯১৯ সালে দেশে ফেরেন ওয়াল্ট। এরপর বাণিজ্যিক শিল্পী হিসেবে যোগ দেন কানসাস শহরের প্রেসম্যান-রুবিন স্টুডিওতে। সেখানেই পরিচয় হয় সহকর্মী শিল্পী ইউবি ইউয়েরক্সের সঙ্গে। ১৯২০ সালে দুজন মিলে তৈরি করেন ইউয়েরক্স-ডিজনি কমার্শিয়াল আর্টিস্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তবে পর্যাপ্ত গ্রাহকের অভাবে মাত্র এক মাস স্থায়ী হয় প্রতিষ্ঠানটি। দুজনই একসঙ্গে যোগ দেন কানসাস সিটি ফিল্ম অ্যাড কোম্পানিতে। এখানে বিভিন্ন মুভি থিয়েটারের জন্য বিজ্ঞাপন তৈরির কাজ করতেন তাঁরা। প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি করার সময় একটি অব্যবহৃত ক্যামেরা নিয়ে তৈরি করেন কার্টুন চরিত্র লাফ-ও-গ্রাম।
১৯২২ সালে জীবনের প্রথম সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ওয়াল্ট। বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে নিজের প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। নাম দেন লাফ-ও-গ্রাম ফিল্মস। কয়েকজন কর্মীও নিযুক্ত করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইউয়েরক্স। টেনেসে শহরের পিক্টোরিয়াল ফিল্মসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে রূপকথার কার্টুনের একটি সিরিজও বিক্রি করেন। তবে সুখের দিন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯২৩ সালের জুলাইয়ে পিক্টোরিয়াল ফিল্মস দেউলিয়া হয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় লাফ-ও-গ্রাম ফিল্মসও। এরপর ভাগ্য পরীক্ষার জন্য ওয়াল্ট পাড়ি জমান লস অ্যাঞ্জেলেসে। চিঠি মারফত যোগাযোগ করেন নিউইয়র্কভিত্তিক কার্টুন পরিবেশক মার্গারেট উইঙ্কলারের সঙ্গে। দুজনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। আবার চলতে শুরু করে লাফ-ও-গ্রাম। ১৯২৪ সালের জুনে থিয়েটারে আসে ডিজনি ব্রোস স্টুডিওর ‘অ্যালাইস ইন কার্টুনল্যান্ড’ স্বল্পদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন ছবিটি। এ ছবির সফলতার পর আবার ইউয়েরক্স ও আরো দুজন অ্যানিমেটরকে সঙ্গে নিয়ে ছবি পরিচালনার দিকে মনোনিবেশ করেন ওয়াল্ট।
কিন্তু মার্গারেটকে বিয়ে করে চার্লস মিন্টজ কার্টুন পরিবেশনা ব্যবসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলে ফের গোল বাঁধে। সে সময় ব্যবসার তুঙ্গে থাকা ‘ফেলিক্স দ্য ক্যাট’ কার্টুনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ওয়াল্টকে একটি চরিত্র তৈরির প্রস্তাব দেন মিন্টজ। নামটিও তিনিই প্রস্তাব করেন ‘অসওয়াল্ড দ্য লাকি র্যাবিট’। ওয়াল্ট কার্টুন চরিত্রটি তৈরি করেন এবং এর ২৬টি সিরিজও বেশ অর্থ উপার্জন করতে থাকে।
সময়ের সঙ্গে খরচা বাড়তে থাকায় অসওয়াল্ড সিরিজের চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের জন্য ওয়াল্ট ও তাঁর স্ত্রী লিলিয়েন নিউইয়র্কে যান মিন্টজের সঙ্গে বৈঠক করতে। মিন্টজ আগের চেয়ে আরো কম অর্থ প্রস্তাব করেন। ওয়াল্টের প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ অ্যানিমেটরকে নিজের দলে ভিড়িয়ে অসওয়াল্ড সিরিজের স্বত্ব নিজের বলে দাবি করেন মিন্টজ।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে স্ত্রীকে নিয়ে নিজের শহরে ফিরে আসেন ওয়াল্ট। শোকাবহ মনেই তৈরি করেন গোল কান ও চওড়া হাসিমুখো একটি ইঁদুরের চরিত্র। নাম দেন মর্টিমার মাউস। পরে মর্টিমারের বদলে লিলিয়েনের দেওয়া প্রাণবন্ত নাম ‘মিকি মাউস’ নামে চরিত্রটি কপিরাইট করে নেন ওয়াল্ট ও ইউয়েরক্স। মিকি মাউসের কয়েকটি সিরিজ (প্লেন ক্রেজি, দ্য গ্যালোপিন গুচো) তৈরি করেন দুই বন্ধু মিলে। তবে পরিবেশকের অভাবে অবিক্রীতই থেকে যায় বোবা এ কার্টুন সিরিজ।
অপেক্ষা করতে হয়নি বেশি দিন। ওই বছরই চলচ্চিত্রে যুক্ত হয় নতুন প্রযুক্তি শব্দ ও রং। নিউইয়র্কের কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানকে শব্দসহ মিকি মাউস চরিত্র ধারণ করার জন্য প্রস্তাব দেন ওয়াল্ট। ‘পাওয়ার্স সিনেফোন সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী প্যাট পাওয়ার্সের সঙ্গে চুক্তি হয় ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর।
১৯২৮ সালের ১৮ নভেম্বর। পৃথিবীর প্রথম শব্দসহ অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র হিসেবে নিউইয়র্কের কোলন থিয়েটারে পরিবেশিত হয় মিকি মাউস সিরিজের প্রথম ছবি ‘স্টিমবোট উইলি’। ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায় এ ছবি এবং ছবির চরিত্র ‘মিকি মাউস’। মিকি মাউসের নামে ক্লাব প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। দেখতে দেখতে ক্লাবের সদস্য সংখ্যা লাখের ঘরে পৌঁছে যায়। তখন থেকেই ২৮ নভেম্বর মিকি মাউসের জন্মদিন পালন করে আসছে পৃথিবীর সব অ্যানিমেশনপ্রেমী।
মিকি মাউসের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ভাগ্যের চাকা খুলে যায় ওয়াল্ট ডিজনির। এগোতে থাকে মিকি মাউস সিরিজের পথচলা। ১৯৪৭ সালে আলাস্কার সিলদের ওপর ভিত্তি করে ‘সিল আইল্যান্ড’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন ওয়াল্ট ডিজনি। সেরা তথ্যচিত্র বিভাগে এ ছবির জন্য একাডেমি পুরস্কার জেতেন ওয়াল্ট। এর ফলেই তৈরি হয় একের পর এক বিশ্বনন্দিত অ্যানিমেশন। ১৯৫০-এ সিনডারেলা, ১৯৫১-তে অ্যালাইস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ও ১৯৫৩ সালে পিটার প্যান।
একজন শিল্পীর ব্যথিত হৃদয়ের সৃষ্টি এই মিকি মাউস। এর স্রষ্টা শুধু টিভি পর্দার মধ্যেই স্থায়ী রাখতে চাননি মিকিকে। ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের স্টুডিওতে বসেই পরিকল্পনা করতে থাকেন ‘মিকি মাউস অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ তৈরির। তার ফলে ফ্লোরিডায় অবস্থিত ‘ডিজনি ওয়ার্ল্ড’ এখন ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। এত কিছুর সৃষ্টি যে মানুষটির জন্য, সেই ওয়াল্টার ইলিয়াস ডিজনি ১৯৬৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি জমান অন্য কোথাও। আর পুরো বিশ্বের মানুষকে বিনোদিত করতে রেখে যান নিজের সেরা সৃষ্টি মিকি মাউসকে।