গল্প
বিজয় দিবসের এক সকালে
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/12/16/photo-1481867425.jpg)
পাল্লা দিয়ে আসছিল বাস দুটো। সাঁই, সাঁই, সাঁই। বেশ দূর থেকেই বাস দুটোকে দেখতে পেয়েছে রফিক। ওর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এখন উপায়?
ভোরবেলা বেরিয়েছে ও। যাবে উজানপুরের মাঠে। ওখানে বিজয়মেলা হচ্ছে। রফিক জানে, আজ বিজয় দিবস। বইতে পড়েছে। বিজয় দিবসের দিন বাংলাদেশের বিজয় হয়। উনিশশ একাত্তর সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
বাবা বেরিয়ে গেছেন সেই ভোরে। রফিকের হাতে লম্বা একটা বাঁশ। চিকন। ওই বাঁশে অনেকগুলো জাতীয় পতাকা আটকানো। পতাকাগুলো বিক্রি করবে মাঠে। সকাল সকাল বাবা ওকে নিয়ে যেতে বলেছেন। সবার ওপরে সবচেয়ে বড় পতাকা। তারপর ছোট। তারপর আরো ছোট। আর সবার নিচে সবচেয়ে ছোট পতাকাটা।
শীতের সকাল। চারপাশ হলুদ। হলুদ শর্ষে ফুলে ছেয়ে আছে। বাতাসে দুলছে শর্ষে ফুলের মাথাগুলো। রফিকের হাতে থাকা পতাকাগুলোও উড়ছে।
শর্ষে ক্ষেত পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠল ও। এটা মহাসড়ক। সাঁই সাঁই করে বাস, গাড়ি, ট্রাক চলে দিন রাত। মহাসড়কে উঠেই ওপারে তাকাল। হুঁ। ওই তো মেলার মাঠ দেখা যাচ্ছে। তবে তার আগে সেতুটা পেরোতে হবে। ছোট্ট একটা সেতু। এটাকে নাকি কালভার্ট বলে।
কালভার্ট পেরোতে গিয়ে চোখ পড়ল ওর। হঠাৎ। আর চমকে উঠল। ঠিক মাঝখানের কয়েক জায়গায় তিনটা গর্ত। রড দেখা যাচ্ছে। এটার ওপর দিয়ে কি গাড়ি যেতে পারবে? বাস যেতে পারবে? বাস উঠলেই যদি সেতু ভেঙে পড়ে?
কালভার্টের এপাশে তাকাল রফিক। আবার তাকাল ওপাশে। ওপাশ থেকে কোনো গাড়ি আসতে দেখা যাচ্ছে না। এপাশ থেকে দুটো গাড়ি আসছে। পাল্লা দিয়ে। দুটো বাস। সাঁই, সাঁই, সাঁই। কার আগে কে সেতুটা পার হবে, যেন সেই প্রতিযোগিতা। কার আগে কে দুর্ঘটনায় পড়বে, যেন সেই প্রতিযোগিতা। খুব খারাপ লাগল রফিকের। চোখের সামনে অমন একটা দুর্ঘটনা ঘটতে দেখবে? হতে পারে না।
এখন উপায়?
ভাবতে লাগল রফিক। বুদ্ধিটা পেয়ে গেল হঠাৎ। কালভার্টে ওপর দাঁড়িয়ে পতাকাদণ্ড নাড়াতে লাগল রফিক। একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে। যত জোরে সম্ভব।
কিন্তু বাস দুটোর থামার নাম নেই। তাহলে কি ওকে দেখতে পায়নি চালক?
এটা তো আর ট্রেন নয়, যে লাল কাপড় দেখালেই বুঝে যাবেন চালক। এটা বাস। তা-ও একটা নয়, দুটো। পাল্লা দেওয়া বাস। পাল্লা দেওয়ার সময় বাসের চালকদের বুদ্ধি যেন হারিয়ে যায় কোথায়। বেপরোয়া চালায়। তখন পথচারীদেরই সাবধান থাকতে হয়। রফিক জানে। কিন্তু এখন যে ভয়াবহ বিপদ। বাসযাত্রীদেরই বিপদ।
পতাকাদণ্ডটা বেশ ভারী। এমনিতে ঘাড়ের ওপর নিয়ে চলছিল ও। শক্ত-পোক্ত গতর ওর। গায়েও বেশ জোর। জোরে জোরে পতাকাদণ্ড নাড়াতে লাগল ও। জোরে নাড়াতে গিয়ে একবার হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। চটপট হাতে তুলে নিল পতাকাদণ্ড। আবার নাড়াতে লাগল। আগের চেয়েও জোরে। কিন্তু বাস দুটোর যে থামার নাম নেই। মনে হচ্ছে সোজা রাস্তা পেয়ে আরো জোরে ছুটছে। আরো জোরে। সাঁই, সাঁই, সাঁই...
এবার ভয় পেয়ে গেল রফিক। ওর গায়ের ওপর বুঝি উঠে পড়ে। এবার আরো জোরে পতাকাদণ্ড নাড়াতে লাগল ও। নাড়াতে নাড়াতে নাড়াতে...
ঘষষষষষ। দেখল কালভার্টের ওপাশে এসে হঠাৎ থেমে গেল বাস দুটো। পাশাপাশি। আর বাস থামতেই দৌড়ে গেল ও বাস দুটোর দিকে।
ততক্ষণে বাস থেকে দু-একজন যাত্রী নেমে গেছেন। কী হয়েছে দেখার জন্য এগিয়ে এলেন সামনে। রফিক আঙুল তুলে কালভার্টটা দেখাল। বলল, গর্ত।
গর্ত! চোখ কপালে উঠে গেল যাত্রীদের।
হঠাৎ কালভার্টের ওপাশে একটা গাড়ি দেখতে পেল রফিক। একটা মাইক্রোবাস। সঙ্গে সঙ্গে আবার কালভার্টের ওপর এসে দাঁড়াল ও। নাড়াতে লাগল পতাকাদণ্ড। ওপাশের মাইক্রোবাসটাও থেমে গেল।
এবার দুই পাশ থেকে সব যাত্রী নেমে এলেন রাস্তায়। ক্ষতিগ্রস্ত কালভার্ট দেখল সবাই। সত্যি খুবই নাজুক কালভার্টটা। এর ওপর দিয়ে কোনো গাড়ি গেলে দুর্ঘটনা ঘটতেও পারত।
কিছুক্ষণ পর দুপাশে অনেকগুলো গাড়ি জমে গেল। যোগাযোগ করা হলো রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের সঙ্গে। আর ঘণ্টাখানেক পরে কালভার্ট মেরামতের জন্য শ্রমিক চলে এলো। সঙ্গে দুজন প্রকৌশলী।
রফিক কিন্তু এত কিছু জানে না। আজ বিজয় দিবস। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে মেলার দিকে চলে গেল ও। ওর ডান কাঁধে পতাকাদণ্ড। দণ্ডে অনেকগুলো পতাকা বাঁধা। সবচেয়ে বড় পতাকাটা ওপরে। যাত্রীরা অবাক হয়ে রফিকের চলে যাওয়া দেখছিল। দণ্ডের একেবারে মাথায় সবচেয়ে বড় পতাকা। পতপত করে উড়ছিল। বাতাস ছিল না, তবু পতাকাটা উড়ছিল কেমন করে!