অভিমত
মাদক নিয়ন্ত্রণে আইন কতটা কার্যকর?

মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগই বেশি হয়–এমন অভিযোগ বহু পুরনো। ফলে সম্প্রতি যখন মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে দেশব্যাপী বড় ধরনের অভিযান চলছে, তখন এই অভিযানকে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগ ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য ১৯৯০ সালে একটি আইন করা হয়; যা কার্যকর হয় ওই বছরের ২ জানুয়ারি। এই আইনে মাদক বলতে যেকোনো মদ, দশমিক পাঁচ শতাংশের বেশি এ্যালকোহলযুক্ত বিয়ার, হেরোইন, কোকেন এবং কোকা উদ্ভূত মাদক, পেথিডিন, মরফিন ও টেট্রা হাইড্রোক্যানাবিনল, অপিয়াম, গাঁজা বা যে কোনো ভেষজ ক্যানাবিস ইত্যাদিকে বোঝায়। যখন এই আইনটি প্রণীত হয়, তখন দেশে ইয়াবা আসতে শুরু করেনি। ফলে ইয়াবার নামটি এই আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশে মাদকের বিস্তার ঘটে মূলত আশির দশকে এবং নব্বই দশকে এটি সর্বগ্রাসী রূপ নেয়, বিশেষ করে ফেন্সিডিলের কারণে। ভারত থেকে আসা এই কাশির সিরাপ মাদকসেবীদের মধ্যে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে, ১৫-২০ টাকার সিরাপ পাঁচ ছয়শো টাকায়ও বিক্রি হত। আমি আমার ছোট্ট জেলা শহরেই দেখেছি, অত্যন্ত প্রতিভাবান আর সম্ভাবনায় অসংখ্য তরুণ কীভাবে এই ফেন্সিডিলের চক্করে পড়ে ধ্বংস হয়েছেন। কৈশোরে আমরা আইডল মানতাম, এরকম একাধিক তরুণকে পরে দেখেছি উন্মাদের মতো রাস্তায় ঘুরছেন। পরে জেনেছি, এর নেপথ্যে রয়েছে ফেন্সিডিল। সেই ফেন্ডিডিলের জায়গা এখন দখলে করেছে প্রতিবেশী আরেক দেশ মিয়ানমার থেকে আসা লাল ট্যাবলেট ‘ইয়াবা’। কোড নাম হিসেবে অনেকে এটিকে ‘বাবা’ বলে ডাকে।
দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক দশক ধরে যে দুটি মাদকের ছোবলে আমাদের তরুণ ও যুবসমাজ ধ্বংস হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান দুটি মাদকের আগমন আমাদের প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র থেকে। শোনা যায়, শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাজার টার্গেট করেই ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ফেন্ডিডিল তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছিল।
আমাদের দেশে এ মুহূর্তে ইয়াবা, গাঁজা, বিভিন্ন প্রকারের মদ, নানারকম কাশির সিরাপ ও ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে তৈরি তরল মাদকের চাহিদা বেশি। হালে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় তৈরি হয়েছে ‘সিসা বার’ যেখানে ধনীর সন্তানরা দল বেঁধে হাজির হচ্ছেন। প্রাচীনকালের হুঁকার নগর সংস্করণকে বলা হচ্ছে সিসা। তামাক ও আফিমের সঙ্গে কথিত ফলের নির্যাস মিলিয়ে হুঁকা টানা হয়।গণমাধ্যমের খবর বলছে, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও এসব বারে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কেননা এটি মাদকের তালিকায় না থাকায় সিসার নেশায় আসক্ত কিংবা তা বেচাকেনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।
যেমন জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পপি ও কোকার চাষ কমে যাওয়ায় হেরোইন ও কোকেনের জায়গা দখল করছে এমফিটামিন, ক্যাটামিন, পাইপারজিনস, মেফিড্রিন, স্পাইস, এক্সটাসির মতো নতুন নতুন মাদক। যেমন ফেন্সিডিলের জায়গা এখন দখল করেছে ইয়াবা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে নতুন প্রকারের মাদকগুলোকে মাদকের পর্যায়ে তালিকাভুক্ত না করার সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
যদিও মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে এরকম একটি বিধান রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি এই আইন বা বিধির এমন কোনো বিধান লঙ্ঘন করেন যার জন্য স্বতন্ত্র কোনো দণ্ডের ব্যবস্থা নেই, তাহলে তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। তার মানে এই বিধানের আলোকেই সিসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়।
মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, কারো কাছে সর্বোচ্চ ২৫ গ্রাম পরিমাণ হেরোইন, কোকেন এবং কোকা উদ্ভূত মাদকদ্রব্য পাওয়া গেলে তিনি অন্যূন ২ বছর এবং অনূর্ধ্ব ১০ বছরকারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন ৷ তবে ২৫ গ্রামের বেশি হলে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ৷
পেথিডিন, মরফিন ও টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনলের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ১০ গ্রাম হলে কমপক্ষে ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড; আর ১০ গ্রামের বেশি হলে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড; অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন বা অপিয়াম উদ্ভূত (হেরোইন ও মরফিন ব্যতীত) মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ২ কেজি হলে ২ বছর থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড; ২ কেজির বেশি হলে মুত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড; মেথাডনের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ৫০ গ্রাম হলে ২ বছর থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড আর পরিমাণ ৫০ গ্রামের বেশি হলে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড; গাঁজা বা যেকোনো ভেষজ ক্যানাবিসের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ৫ কেজি হইলে অন্যুন ৬ মাস এবং অনূর্ধ্ব ৩ বছর কারাদণ্ড এবং ৫ কেজির ঊর্ধ্বে হলে ৩ বছর থেকে ১৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
তবে এই ধারায় উল্লিখিত কোনো অপরাধের জন্য দণ্ড ভোগ করার পর যদি কেউ আবারও এই ধারার উল্লিখিত কোনো অপরাধ করেন, তাইলে ওই অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না হলে, তিনি সর্বোচ্চ যে দণ্ড রয়েছে, তার দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে প্রদত্ত পারমিট ছাড়া কোনো ব্যক্তি এ্যালকোহল পান করতে পারেন না। তবে চিকিৎসার প্রয়োজনে অন্যুন সিভিল সার্জন বা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের কোনো সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্রের ভিত্তিতে তিনি নির্ধারিত মাত্রায় অ্যালকোহল পান করতে পারেন। এই আইনের সত্যিকার প্রয়োগ করতে গেলে দেশের সবগুলো বার বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বারে গিয়ে যারা মদ্যপান করেন,তাদের অধিকাংশেরই পারমিট বা অনুমতি নেই। এ নিয়ে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক যতই থাকুক, প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিনা পারমিটে মদ্যপান বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদিও এই আইনে মুচি, মেথর, ডোম, চা বাগানের কুলি ও উপ-জাতীয়রা নিজেদের তৈরি তাড়ী ও পঁচুই পান করার ক্ষেত্রে এবং রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার উপজাতীয়দের ঐতিহ্যগতভাবে প্রস্তুতকৃত মদ তারা নিজেরা পান করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আইনে কোনো বাধা নেই।এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এ্যালকোহল গ্রহণ করা যায়।সেইসাথে বিদেশি নাগরিকরা লাইসেন্সপ্রাপ্ত বারে বসে এ্যালকোহল পান করতে পারেন।
দেখা যাচ্ছে, মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনটি বেশ শক্ত। কিন্তু তারপরও কেন মাদক নির্মূল হচ্ছে না বরং মাদক ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন তরিকা আবিষ্কার করছে? অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পান। সেইসাথে রাজনৈতিক নেতাদের একটি অংশ মাদক ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দেন। বিশেষ করে মাদক পাচারের রুটগুলো নিরাপদ রাখতে তারা ভূমিকা রাখেন। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ইয়াবাসহ মাদকের ব্যবসা রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
পুলিশ সদর দফতর থেকে সারা দেশের পুলিশের জন্য যে ১০ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, যেসব পুলিশ সদস্য মাদক বিক্রেতার কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন, তাদের চিহ্নিত করে বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা, প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হবে। একটি জাতীয় দৈনিকের খবর অনুযায়ীম মাদকে জড়িত থাকার অভিযোগ ইতিমধ্যে ৬৭ জন পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সব সময়ই এটা বলা হয় যে, আইনটি কেমন বা এর দ্বারা জনমানুষের কী উপকার হবে, তার পুরোটাই নির্ভর করে প্রয়োগকারীর নিয়তের উপর।অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যই যদি থাকে অভিযানের নামে মানুষকে ফাঁসানো বা মোটা অংকের টাকা আদায়, তাহলে আইনটি কাগজপত্রেই থেকে যাবে। কালেভদ্রে কিছু মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও রাঘববোয়ালরা স্পর্শের বাইরেই থেকে যাবে।আরেকটি সমস্যা তদন্ত ও বিচারিক দুর্বলতা।বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীও অনেক সময় গ্রেপ্তার হয়ে কিছুদিন পরেই জামিনে বেরিয়ে আসে। দেশে ভয়াবহ মাদকের বিস্তার, অথচ মাদক মামলায় কোনো রাঘব বোয়ালের বড় ধরনের সাজা হয়েছে, তার নজির নেই। যে কারণে মাদকের বিরুদ্ধে চলমান এই অভিযানকে সাধারণ মানুষ সাধুবাদ জানাচ্ছে। সেইসাথে নাগরিক সমাজের তরফে এই আহ্বানও রয়েছে যাতে মাদক নির্মূলের নামে কোনো নিরীহ লোক ভিকটিম না হয় বা এই অভিযানটি যাতে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়।
লেখক: সাংবাদিক।