কাপ যুদ্ধ
যতক্ষণ মেসি-রোনালদোর নাচ ততক্ষণ আর্জেন্টিনা-পর্তুগালের শ্বাস
মেসি ছাড়া বিশ্বকাপ। সেটা হয় না কি। হবে না কেন? ইতালি ছাড়া বিশ্বকাপ হচ্ছে না। জার্মানি চলে গেছে। বিশ্বকাপ হচ্ছে না? হচ্ছে। তাহলে মেসি চলে গেলে কি সোনালি রঙের কাপটা তার রং হারাবে? সেটা বিষাদে নীল হয়ে যাবে? রাশিয়ায় যদি ফরাসি বিপ্লবের মতো কিছু ঘটে তাহলে আর্জেন্টিনাকে বিদায় নিতে হবে। মেসির বিশ্বকাপও শেষ হয়ে যাবে।
বিশ্বকাপের নক আউট পর্বের প্রথম ম্যাচটা ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেই ম্যাচটার ট্যাগ লাইন হয়ে গেছে;‘ ফ্রান্স বনাম মেসি।’ এই ম্যাচের আগে কেন হারিয়ে গেল ফুটবলের চিরকালীন কথাটা। খেলাটা এগারজনের।একার নয়।
কিন্তু সব কেনর জবাব থাকেন না। কেন ম্যাচটা আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্স না হয়ে সমর্থকদের কাছে হয়ে দাঁড়াছে মেসি বনাম ফ্রান্স। উত্তর খুঁজে না পাওয়া এই প্রশ্নেরও আবার একটাই উত্তর। খেলাটা ফুটবল। এবং তিনি মেসি। প্রতিপক্ষের এগারজন ৯০ মিনিট বা ১২০ মিনিটে যা করতে পারেন মেসি সেটা একাই পারেন। এবং পারেন ১ থেকে ২ সেকেন্ডে। তিনি সেটা করেও দেখিয়েছেন। এই বিশ্বকাপেই করে দেখিয়েছেন। মেসি পারেন। আবার মেসি পারেন না। মেসি আইসল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করেন। আটলান্টিকে টাইটানিক ডুবে যাওয়ার মতো আর্জেন্টিনাও আইসল্যান্ডের কাছে ধাক্কা খেয়ে, ক্রোয়েশিয়ার কাছে বিধস্ত হয়ে ডুবতে বসেছিল। টাইটানিকের ক্যাপ্টেন ডুবতে যাওয়া জাহাজকে ভাসিয়ে রাখতে পারেননি। আর্জেন্টিনা নামক ফুটবলীয় টাইটানিককে কিন্তু মেসি ভাসিয়ে রাখলেন। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে এবারের বিশ্বকাপে নিজের প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র গোলটা করে। ১৩ মিনিট ৫২ সেকেন্ডে বেনেগার কাছ থেকে বলটা পেয়েছিলেন। চলন্ত বলটা বা পায়ের উরু দিয়ে নামালেন। একটা টোকা দিয়ে বলটাকে সামনের দিকে বার চারেক রোল করালেন। তারপর ডান পায়ে বলটা নাইজেরিয়ার জালে পাঠালেন। সব মিলিয়ে এই ‘ফুটবলীয় অনুকাব’ লিখতে লিওনেল মেসি সময় নিলেন ২ সেকেন্ড। সেই মেসি আজ বিদায় নিলেও রাশিয়ায় বিশ্বকাপ থাকবে। কিন্তু আর্জেন্টিনা সমর্থক আর মেসি ভক্তদের চোখে জল ঝরবে। কারণ, লিওকে নিয়ে ফুটবল বিশ্বে প্রায় ৩৫ শতাংশ স্বপ্ন দেখেন। কাপ হাতে মেসিকে দেখার স্বপ্ন তাদের দু’চোখ ভরা। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেই মেসির আর্জেন্টিনা যখন ক্রসবিদ্ধ হলো, গ্যালারিতে কী দেখেছিল ফুটবল বিশ্ব? ছেলের চোখের জল মুছে দিচ্ছেন বাবা। অথচ তিনিও অঝরে কাঁদছেন। প্রেমিকার চোখের জল মুছে দিচ্ছেন প্রেমিক। আজ মেসির বিদায় হলে এরচেয়েও করুণ কিছু দৃশ্য হয়তো দেখবে ফুটবল বিশ্ব। তাই এই ম্যাচটা সত্যিই মেসি বনাম ফ্রান্স। সেখানেও আবার লড়াইয়ের মধ্যে কত লড়াই থাকতে পারে। মেসির জাদু নাকি গ্রিজম্যান-ডেমবেলে-দের গতি ঝড়? দুই সাবেক চ্যাম্পিয়নের লড়াইয়ে মানুষ দেখতে চাইবে সুন্দর ফুটবল। সেটা মেসির জাদুতে হোক কিংবা গ্রিজম্যান-ডেমবেলেদের দলীয় সংহতিতে হোক। ফুটবলের জয়টাই হোক।
তবে ফুটবল সেটা কী শুধুই একটা খেলা? যদি তাই হতো তাহলে এই বিশ্বকাপ নিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের আবেগের রাতে এত প্রবলভাবে বইবে কেন? এই সব কেনরও কোনো জবাব নেই। জবাব হতে পারে একটাই। ফুটবল জীবনেরও প্রতিরুপ। কত উত্থান-পতন-হাসি-কান্না-আনন্দ-উচ্ছ্বাস-বেদনা-বিষাদের কাব্য ফুটবলকে ঘিরে। এই যে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে যেভাবে ম্যাচ জিতে নক আউট পর্বে এলো আর্জেন্টিনা এটা কী শুধুই একটা ম্যাচ জয়? না। এটা হচ্ছে জীবন সংগ্রামের দারুণ এক কোলাজ। নাইজেরিয়ার জয়ের দরকার পড়ত না। শুধু ড্র করলেই শেষ হয়ে যেত আর্জেন্টিনার নক আউট পর্বে ওঠার স্বপ্ন। কিন্তু তারা উঠে এলো। সেখানেও মানুষ খুঁজে পেল লড়াই –সংগ্রামের দারুণ এক দর্শন।
হ্যাঁ, দর্শন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই করুন সাফল্যের জন্য। নুয়ে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াতে হয়। দেশের জয়ের জন্য শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করতে হয়। জাভিহার মাসচারানো নামের এক ফুটবলার কী সেটা করে দেখালেন না। রক্তমাখা মুখ। যে মুখটা যন্ত্রণা কাতর। তবু তিনি মাঠ ছাড়তে রাজি নন। এটাই লড়াইয়ের দর্শন। এই লড়াইয়ে যদি উদ্ধুদ্ধ হয় মেসি এবং তার দল, তাহলে তারুণ্য নির্ভর ফরাসিদের গতি, স্কিলও হার মেনে যেতে পারে। রাশিয়ায় ফরাসি ফুটবল বিপ্লবের পতাকা নাও উড়তে পারে। কারণ, মেসি সেই দেশের যে দেশ জন্ম দিয়েছে চে গুয়েভারার মতো বিপ্লবীকে।
বিপ্লবের রং লাল। সেই লাল রং কিন্তু আর্জেন্টিনা দেখিয়েছে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে বাঁচা –মরার ম্যাচে। মাশচারানোর মুখ লাল হয়েছে রক্তে। ম্যাচ শেষে আবার দেখা গেলে মেসির পায়ে লাল তাবিজ। তাবিজ পায়ে মেসি। তাহলে কী এই মেসি ঠিক ভিন্নগ্রহের কোনো মানুষ নন। তিনি ঈশ্বরও নন। তিনি রক্ত-মাংসের একটা মানুষ। তাঁর পা দুটো অবশ্য ঈশ্বরের কি না সেটা চর্চা চলে। ঈশ্বরের পা হোক আর মানুষের পা হোক এই পা দুটো দৌঁড়ানোর জায়গা পেলে ফরাসি দুর্গে হামলা হবেই। কতক্ষণ তারা সেই দুর্গ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন সেটাই প্রশ্ন। তারও আগে প্রশ্ন, ফরাসিদের গতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা কী আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডারদের আছে? মাঝমাঠে বল হোল্ড করার ফুটবলার কোথায় আর্জেন্টিনায়? মেসিকে নিখুঁত পাস বাড়ানো মিডফিল্ডার কী আছে তাঁর পাশে? আবার মেসি ডিফেন্স চেরা পাস বাড়ালে সেটা ধরে গোল করার মতো ফরোয়ার্ড় কী আছে এই আর্জেন্টিনা দলে? হিগুয়েন, অ্যাগুয়েরো যত গোলই করুন না কেন জুভেন্টাস আর ম্যানসিটির হয়ে। আর আর্জেন্টিার পোস্টে বল গেলে তো গোটা আর্জেন্টিনার হৃদকম্পন থেমে যায়। এত নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস তাদের গোলোপস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর। তাহালে থাকলো কী? ঐ সেই এক মেসি। তাহলে ম্যাচটার গায়ে কেন লাগানো হবে না মেসি বনাম ফ্রান্সের ট্যাগটা।
ফুটবল এগারজনের খেলা। কিন্ত একজন মেসি মাঠে থাকলে কে আর সে কথা মনে রাখেন। আর এই আর্জেন্টিনাকে ঘিরে তো একটা বাক্যের-ই চর্চা হচ্ছে; ‘যতক্ষণ মেসি নাচবেন, ততক্ষণ শ্বাস চলবে আর্জেন্টাইনাদের।’
ও হ্যাঁ, এই নাচ আর শ্বাসস কথা দুটো আরেকটা দল আর একজন ফুটবলারের বেলায় সত্য। তিনি আবার ফুটবল গ্রহে মেসির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং তাঁর পর্তুগাল। তারাও নক আউটে আজ মুখোমুখি হচ্ছে আরেক সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী উরুগুয়ের জমাট বাঁধা ডিফেন্স আর সুয়ারেস-কাভানি নামের আক্রমণের দুই ফালা তৈরি হয়ে আছে বিশ্বকাপে পর্তুগিজ অভিযান থামিয়ে দিতে। কিন্তু রোনালদোকে থামাতে না পারলে জার্মানির মতো দেশে ফিরতে হতে পারে বিশ্ব কাপের দুই দুই বারের চ্যাম্পিয়নদের।
আবার আর্জেন্টিনা-পর্তুগাল দুটো দলই জার্মানির মতো বিদায় নেয়, তাহলে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাকি সময়ে নতুন এক চর্চা চলবে। গোট চর্চা। হ্যাঁ, গোট। বিড়াল-টিয়া পাখির জ্যোতিসচর্চা নয়। গোট চর্চা! টেনিস বিশ্বের মহাতারকা রজার ফেদেরারকে নিয়েই এই শব্দটা বেশি উচ্চারিত হয়েছে। গ্রেটেস্ট অব অল টাইম- গোট। বিশ্বকাপ থেকে খালি হাতে বিদায় মানে মেসি-রোনালদোদের সর্বকালের সেরা হওয়ার লড়াইও শেষ! হয়তো বলা হবে; ওরা কীসের অলটাইম গ্রেট। বিশ্বকাপই তো জিততে পারেনি।
মেসি কিংবা রোনালদো এই অভিযোগের বাণবিদ্ধ হবেন না কি কাপ নিয়ে দেশে ফিরবেন। না পারলে মার্ক টোয়েনের মতো করে কোনো এক সময় নিজেদের নতুন আত্মজীবনীতে লিখবেন; ‘জীবনের শীতলতম দিন আমি দেখেছিলাম রাশিয়ায় এক গ্রীষ্মে!’
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।