অফুরন্ত সম্ভাবনার বাংলাদেশ

Looks like you've blocked notifications!

দেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস আজ ২৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। পরাধীনতার শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসা সহস্র বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আত্মমর্যাদায় বলীয়ান একটি জাতির একজন হতে পেরে গর্বিত। কারণ ১৯৭১ থেকে ২০২৩-এর পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ আজ অন্য রকম এক বাংলাদেশ।

বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বিশ্ব নেতাদের মতে, বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল, কারো মতে, অফুরন্ত সম্ভাবনার এক বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। পরাজিত হয় একসময়ের সমৃদ্ধ দেশ পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের চেয়ে এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে ভারতের থেকেও এগিয়ে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথচ ভারত-পাকিস্তানের অনেক পরে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। কিন্তু স্বাস্থ্য-শিক্ষার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে ভারত-পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জিডিপি ও মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আত্মপরিচয় অনুসন্ধানকালে জানতে পারি,রাষ্ট্রভাষার অধিকার লাভে বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয় ১৯৫২ সালে। এরপর পাকিস্তানিদের ক্রমাগত শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য, অধিকার হরণ বাঙালির ক্ষোভকে ক্রমেই জমাট করে। ১৯৬৬-এর ৬ দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান- এসবের ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে এবং সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের স্বৈর-সামরিক চক্র গণতন্ত্রের রায় মেনে না নিতে শুরু করে নানান টালবাহানা, চালাতে থাকে নানান ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। সারা বাংলার মানুষের প্রাণের দাবি শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা পরিণত হয় এক দফায়। শুরু হয় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতির চাওয়া ভাষা পায় বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপর মুক্তিপাগল মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণা যখন প্রচারিত হয় তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অর্থাৎ ক্যালেন্ডারের হিসাবে তখন ২৬ মার্চ। এ কারণেই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। দীর্ঘ ৯ মাসের সেই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়, সম্ভ্রম হারায় ২ লাখ মা-বোন। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী। অর্জিত হয় স্বাধীনতা। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম অধ্যায় হলো- স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় পরাজিত গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়। জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধগুলোর মূলে শুরু হয় কুঠারাঘাত। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকড় উপড়ে ফেলার নীলনকশার বাস্তবায়ন চলে। কয়েক দশক ধরে স্বাধীনতার ইতিহাস নানাভাবে বিকৃত করা হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশ। চেষ্টা চলছে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নেওয়ার। আশার কথা যে, আজকের তরুণরা বাংলাদেশের শিকড়ের সন্ধান করেছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সব চেয়ে বড় অর্জন হাজার বছর পর অভিন্ন লক্ষ্যে জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া, সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য ও সংহতির কারণে যেকোনো জাতীয় শত্রুর জন্য দুর্দমনীয় রূপ ধারণ করা। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন হলো শোষণ,বঞ্চনা,নিষ্পেষণ থেকে মানুষের ধীরে ধীরে জেগে ওঠার ইতিহাস। মুক্তি আন্দোলন শুরুতে যতটা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন তার থেকে বেশি ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে কতটুকু বলবান করে তার একটি প্রামাণ্য উদাহরণ বাংলাদেশ। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের আত্মানুসন্ধানের প্রচেষ্টা। একটি জাতি যখন নিবেদিতভাবে আত্মানুসন্ধানে রত হয়, তাদের ভাষা,সংস্কৃতি,ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাতন্ত্র্য আবিষ্কার করে তখন তাদের একটি অভাবনীয় বোধোদয় ঘটে থাকে। আত্মানুসন্ধানের পর যদি মনে হয় বহমান আত্ম-পরিচয়টি আরোপিত, অর্জনটি অলীক স্বপ্নের মতো,স্বপ্ন তখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়,স্বপ্ন অর্জনে আনন্দের থেকে বেদনার মাত্রা থাকে অধিক।

পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে তথা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য, জাতির অধিকার আদায়ের জন্য, সর্বোপরি একটি পতাকার জন্য এদেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করে ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে এনেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে জনমুখী ও টেকসই উন্নয়ন, সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে স্মরণ রাখতে হবে আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতিকে- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। একাত্তরে এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে দখলদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন এই মূলনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাতিসত্তায় রূপান্তর করে ‘বাংলাদেশ’ নামক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার নেতৃত্বের একমাত্র কৃতিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এ কারণেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস যতদিন, যতবার লেখা হবে, পড়া হবে, ততদিন, ততবার বঙ্গবন্ধু বারবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। উপনিবেশ-উত্তর আমলে বাংলাদেশই একমাত্র ভূখণ্ড, যেটি নৃতাত্ত্বিক-ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এর আগে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার কোথাও এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি। আমাদের আরেক স্মরণীয় সাফল্য হলো মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে আমরা পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলাম। স্বাধীনতা আমাদের রক্তে কেনা অর্জন। বঙ্গবন্ধুর মতো এক জন মহামানবের জন্ম এই মাটিতে হয়েছিল বলে আমাদের এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের এই অর্জনকে অর্থবহ করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারির ফলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও বাংলাদেশ অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই মনে করছেন। করোনা মোকাবিলা সক্ষমতায় অভূতপূর্ব অগ্রগতিকালে ইউক্রেনের যুদ্ধ পৃথিবীর সব দেশের মতোই বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিশেষ অভিঘাতের জন্ম দিয়েছে। তবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় সংকট মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকগুলো আমাদের আশাবাদী করে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে অভাবিত উন্নয়ন এবং জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের ফলে। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছি। আমাদের এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে। উন্নয়নের এ গতিধারা কেউ রোধ করতে পারবে না। এ দেশের স্বাধীনতাকামী সব মানুষের এটাই চাওয়া।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,  ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা।