আপনার স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই

Looks like you've blocked notifications!

প্রিয় ভাস্করদা, চলে যাওয়াটা চিরন্তন সত্য। তবে এ সত্যটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। যখন থেকে শুনেছি ভাস্করদা আর নেই, তখন থেকে যেন ইহলোক ও পরলোকে হেঁটে বেড়াচ্ছি আমি! আপনার স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত।

আপনি কত গুণী শিল্পী, কতটা দক্ষ অ্যানিমেটর, এ বিশ্লেষণে আমি যেতে চাই না। কারণ, তার মূল্যায়ন করার যোগ্য নিজেকে ভাবতে পারি না আজও।

আজ একজন মানুষের কথা বলতে চাই। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর, আমার নতুন কর্মস্থল এনটিভি। নতুন আমি। সবাই আমার নতুন নয়, পূর্ব পরিচিত অনেকেই। বেশি সময় লাগেনি সবার সাথে অফিসের কাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে। এখানে সবাই একে অন্যের কম্পিউটারে কাজ করে, করতে হয়। রোস্টার ডিউটি, তাছাড়া টেলিভিশন বা মিডিয়াতে এমনটা হরহামেশা হয়ে থাকে। আমি ভাস্কর দার পিসি অনেক ব্যবহার করি, এ মেশিনের যে সফটওয়্যার, তাতে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। দাদার কাছ থেকে প্রায়ই আমি না জানা টিপস জিজ্ঞেস করে তার সমাধান নিয়ে নিতাম। দাদা কখনও কার্পণ্য করতেন না তাঁর জানা জ্ঞানভাণ্ডার ভাগ করে দিতে। আমিও গোগ্রাসে অনেক কিছু গ্রাস করে নিয়েছি তাঁর কাছ থেকে।

ভাস্করদা সবার চেয়ে আলাদা, গড়নে পাতলা বা রোগা বলা যায়। নিজের শরীরের তুলনায় ঢোলা বা বড় সাইজের কাপড়েই বেশি আসেন অফিসে। একটা ব্যাগ, কখনও কখনও দুইটা; অনেক জিনিস সাথে থাকে। আইফোন, ম্যাকের ল্যাপটপ, জলের বোতল, বিস্কুট, চকলেট (রাসায়নিকমুক্ত), আরও হরেক প্রকার ওষুধ। মাঝে মাঝে দাদা বলতেন, সিপন এই একটা ট্যাবলেটের দাম কত বলতে পারো? এমন ওষুধ খেতে হয় রোজ। সদা রসিকজন। কোনও দিন মনখারাপ থাকতে দেখিনি। হ্যাঁ, অসুস্থতায় তাঁকে প্রায়ই রোগা ও মলিন দেখিয়েছে।

একদিন জানতে পারি ভাস্করদার কিডনি অকেজো, গত কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা চলছে। সব কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় তাঁর। কতটুকু জল পান করবেন, কী খেতে পারবেন কী খেতে পারবেন না—সব কিছু নিয়মতান্ত্রিক। জেনে যেমন মন হাহাকার করেছে, ঠিক উল্টো অনেকটা অবাক হয়েছি কীভাবে একজন জটিল অসুখ নিয়ে তাঁর স্বাভাবিক জীবন যাপন চালিয়ে যাচ্ছেন? প্রথমে সপ্তাহে দুটি ডায়ালিসিস চলত, পরে তা বেড়ে তিনটি হয়ে গেছে; তখনও তাঁর নিত্যদিনের কাজ বা মনের খোরাক থেমে যায়নি।

ভাস্করদার কাছ থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা পেয়েছি, তা হলো—শেষের আগে শেষ বলো না। আমি আজও অবাক হই, সামান্য জ্বর কাশি গা ব্যথা হলে আত্মা হাওয়া হয়ে যাওয়া ব্যক্তি আমি। তবে চেষ্টা করি তাঁর মতো ভাবতে—শেষের আগে শেষ হতে নেই। কিন্তু পারি না পারছি না পারব না; এত সহজ নয় জীবন, যতটা যাপিত জীবনে ভাস্করদা পেরেছেন, আমি তা কখনওই পারব না। একজন ভালো মানুষ, যাঁকে ভালো লাগার কারণের শেষ নেই... কখনও রাগতে দেখিনি। তবে হাসতে দেখেছি জীবনের অন্তিম সময়েও, কখনও অন্যের কাছে বোঝা বানাননি নিজেকে; অফিসের কোনও পেন্ডিং কাজ অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেননি। যে কোনও জটিল প্রোগ্রামিং যতক্ষণ আয়ত্ত করতে না পারতেন, ততক্ষণ নেটের দুনিয়ায় ডুবে থাকতেন। সফল করে ফেলে সে কী আনন্দ।

দাদা, আপনি সত্যিই অসাধারণ। জীবনে অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি, হয়তো আসব, তবে এ জীবনে আর একটা ভাস্করদার দেখা পাব না, এটা হলফ করে বলতে পারি। আপনার কাছ থেকে জীবনের নতুন গান শিখেছি—মৃত্যু আসবে, তা কেউ থামাতে পারবে না; তবে শেষের আগে শেষ নয়।

লেখক : সিনিয়র গ্রাফিক ডিজাইনার, এনটিভি