এনটিভির সাথে আগামীর পথে

Looks like you've blocked notifications!

বিশ বছর। একেবারে কম দিন নয়, দুই দশক। এই দুই দশক ধরেই আমি কাজ করছি এনটিভির সাথে। তবে এখনও মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। হাজারও ঘটনা, হাজারও। কিন্তু কোনটা রেখে কোনটা লিখব, তা ঠিক করে উঠতে পারছি না।

এনটিভিতে যোগদানের আগে আমি দৈনিক মানব জমিনের দক্ষিণাঞ্চল প্রতিনিধি ছিলাম। এনটিভি সম্প্রচারে যাওয়ার মাসখানেক আগে কোনও একটা কাজে ঢাকা গিয়েছিলাম। মানব জমিনের মতি ভাইয়ের (মতিউর রহমান চৌধুরী) সাথে কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, ‘নতুন একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসছে, চ্যানেলটা ভালো হবে। তৈয়ব, তুমি যেহেতু  ভালো রিপোর্ট করো। তাই তুমি যোগাযোগ করতে পারো। চ্যানেলটি কিন্তু সাড়া জাগাবে।’ মতি ভাইয়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে সেদিনই আমি কারওয়ান বাজারে এনটিভির অফিসে যাই।

অফিসে তখন ডেকোরেশনের কাজ শেষ হয়নি। প্রধান বার্তা সম্পাদক রাশেদুন্নবী বাবু ভাই। দৈনিক বাংলার সিনিয়র সহকর্মী হিসেবে তিনি পূর্বপরিচিত ছিলেন। তাঁর সাথে দেখা করে নিজের আগ্রহের কথা জানাতেই তিনি বলেন, ‘এখানে ইউনিয়নবাজি করলে চাকরি হবে না। আরও অনেকেই আছে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারলেই চাকরি হবে।’

সব সময় চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আগ্রহ। তাই খুলনায় এসেই নতুন ধরনের আইটেমের খোঁজ শুরু করে দিই। তখন নিউজ পাঠাতে হতো ফ্যাক্সে, আর ফুটেজ ভিডিও ক্যাসেট করে বিমানে বা কুরিয়ারে পাঠাতে হতো। এনটিভি সম্প্রচারের প্রথম দিনেই খুলনায় চরমপন্থিরা দুই পুলিশ সদস্যকে  হত্যা করে তাদের অস্ত্র লুট করে নেয়। দেশজুড়ে আলোচিত এই খবরটি সেদিন এনটিভিতে প্রচার হয়। এনটিভি প্রতিষ্ঠাকালে খুলনা অঞ্চলে চরমপন্থিদের তৎপরতা ছিল বেশি। ফলে প্রায় সংবাদেই খুলনার খবর থাকত। চরমপন্থিদের নিয়ে মোস্তফা ফিরোজ আর মঞ্জুরুল করিমের অনুসন্ধানী নিউজ পরবর্তীতে সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সহায়তা জুগিয়েছিল।

লেখার মুনশিয়ানার চেয়ে ভিডিও বা ফুটেজকে প্রাধান্য দেওয়াই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বৈশিষ্ট্য। প্রথম দিকে ভরসা ছিল একুশে টিভির সাবেক ক্যামেরাম্যান কচি ভাই। তাঁর ভিডিও দোকানের ক্যামেরাম্যান নিয়ে ফুটেজ পাঠানো শুরু করি। তারপর নভেম্বর মাসে এক রাতে তৎকালীন বার্তা সম্পাদক খায়রুল আনোয়ার মুকুল ভাইয়ের টেলিফোন পেলাম। তিনি ঢাকা অফিসে যাওয়ার কথা বলে জানালেন, পৌঁছে যেন ফাহিম ভাইকে রিপোর্ট করি। তিনি আরও জানান, প্রাথমিকভাবে আমাকেই চূড়ান্ত করা হয়েছে।

ঢাকা অফিসে সেদিন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকার বাইরে সেদিন মোট ১১ জনকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগপত্র তুলে দেন চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী স্যার।

দৈনিক ইত্তেফাক দিয়ে সাংবাদিকতা শুরুর পর প্রয়াত শামছুর রহমান ভাইয়ের পরামর্শে  দৈনিক বাংলায় যোগ দিই। দৈনিক বাংলা বন্ধ হলে দৈনিক মানব জমিনে। দীর্ঘদিন মুদ্রণ মাধ্যমে কাজ করার পর ইলেকট্রনিক মাধ্যমে যোগদানের পর নিত্য-নতুন অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে থাকি। চরমপন্থিদের নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য আসেন মোস্তফা ফিরোজ, এরশাদ শিকদারের ফাঁসির সংবাদ কভারেজের জন্য আসেন সুপন রায়। তাঁদের শেখানো কৌশলে এগোতে থাকি। নিজেই ক্যামেরা চালাই, এডিট করি; আবার ক্যাসেটে করে তা বিমানে বা কুরিয়ারে পাঠাতে থাকি।

এনটিভিতে দেশের খবর শুরু হলে পর পর টানা তিন দিন আমার প্যাকেজ প্রচার হয়। ভিন্ন স্বাদের খবর আর মুক্তাঙ্গন নামে একটি অনুষ্ঠানে সমস্যাভিত্তিক সাক্ষাৎকার প্রচার হতো। এ জন্য  আলাদা সম্মানী দেওয়া হতো। এই দুই বিভাগ হতে আমার আইটেমভিত্তিক সম্মানী ছিল সবচেয়ে বেশি।

ঢাকা ডেস্ক-এর আনিস ভাই খুলনায় ক্যামেরাম্যান নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন দেন। প্রথম ক্যামেরাম্যান ছিলেন সোহেল মাহমুদ। তিনি বুঝতেন, কোনটা লাগবে আর কোনটা লাগবে না।

তখন মঈন ইউ আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাল। উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল খুলনা এসেছেন। সিটি করপোরেশনে অনুষ্ঠিত সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়ে তিনি মাইকে বলেন, খুলনা ছেড়ে তিনি বরিশাল যাবেন, সেখানে মন্ত্রিসভার বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এ সময় বেশির ভাগ ক্যামেরাম্যান তার গোছাচ্ছিলেন। সাংবাদিকেরা কথাটি খেয়াল করেননি। আমি দৌড়ে সোহেল মাহমুদের কাছে জানতে চাইলাম শেষটা রেকর্ড আছে কি না। তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। ওই কথাটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন করি। ঢাকা বিমানবন্দর হতে ক্যাসেট নিয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যার নিউজ মূল খবর ছিল সেটি; উপজেলা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত আসছে। উপদেষ্টার নিজের মুখের কথা, তাই এর কোনও প্রমাণ লাগেনি। পরে উপদেষ্টা আমাকে বলেছিলেন, আমি তো আবেগে বলে ফেলেছিলাম, আর তুমি তাই নিউজ করে দিলে! আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানার পর এনটিভির ঢাকা থেকে আসা টিম সুন্দরবনের দুবলা চরে গিয়ে আটকে পড়েছিল। ফলে এনটিভি প্রকৃত ফুটেজ দিতে পারছিল না। এক দিন পর রাতে আনিস ভাই ফোন করে বলেন, যে করেই হোক ফুটেজ নিউজ করতে হবে। ঘটনাস্থল ছিল বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলা। পরদিন খুব ভোরে মোটরসাইকেলযোগে রওনা দিই। তখনও সেনাবাহিনী সড়কের ওপর পড়ে থাকা গাছ পরিষ্কার করছে। সকাল ৮টায় শরণখোলা বাজার থেকে নৌকায় করে বলেশ্বর নদীর তীরে যাই। ওই গ্রামে কোনও  বাড়ি ছিল না। যেখানে-সেখানে লাশ, মরা গরু-ছাগল ভাসছিল। গ্রামের ছবি নিয়ে ঘাটে এসে দেখি নৌকা নেই, পার হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কী হবে এই ভাবতে ভাবতে দেখি সেনাবাহিনীর একটি দল ট্রলারে যাচ্ছে। হাত উঁচিয়ে তাদের ডেকে নিজেদের আটকে পড়ার কথা জানাই। মেজর সাহেব এনটিভির কথা শুনে আমাদের শরণখোলা পৌঁছে দিলেন। রাতে কুরিয়ারের ক্যাসেট ধরাতে হবে, এমন ভাবনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খুলনায় সুন্দরবন কুরিয়ারে পৌঁছে দেখি, তাদের গাড়ি ছাড়ছে, গাড়ি থামিয়ে ক্যাসেট বুক করা হয়। সেদিন ভোর থেকে না খাওয়া। রাতে খাওয়ার পর নিউজ লিখে ফ্যাক্সে পাঠাই। পরদিন সকালে মুকুল ভাইয়ের ফোন। তিনি জানতে চাইলেন, শরীরটা কেমন, ইত্যাদি। কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম, নিউজ ফুটেজে কি কোনও ভুল হলো? এর মধ্যে ভাইয়ের  ফোন, তিনি ফুটেজের বিবরণ নিলেন। কিন্তু মুকুল ভাইয়ের ফোন আর ভালো-মন্দ জানতে চাওয়া আর মনোযোগ দিয়ে কাজ করার পরামর্শ আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। মন খারাপ করে দুপুরের নিউজ দেখিনি। তবে দুপুরের নিউজের পর এনটিভির বর্তমান হেড অব নিউজ জহিরুল আলম ফোন করে বলেন, ভালো কাজ করেছেন, নিউজটা ভালো হয়েছে। তারপর মনটা ভালো হয়ে যায়। বিকেলে নিউজটা দেখি। আমি নিজেই হতবাক বনে যাই। ভাবতে পারছিলাম না, এটাই আমার নিউজ। ছোট্ট শিশু বাহাদুর ঝড়ে বাবা-মাকে হারিয়ে নিজ ভিটায় বসে কাঁদছিল। সেই নিউজ দেখে বহু মানুষ তার সহায়তায় এগিয়ে আসে।

তারপর সোহেল মাহমুদ এনটিভি ছেড়ে ইন্ডিপেনডেন্ট টিভিতে যোগদান করলে আমি আজিজুলকে নিয়ে পথচলা শুরু করি। আমার অসংখ্য নিউজ সর্বজনের নজর কেড়েছে।

এনটিভি পরিবার আসলেই ব্যতিক্রম। তারাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যে প্রতিনিধিদের ল্যাপটপ দিয়েছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কোনও কর্মীর বেতন বকেয়া পড়েনি। এনটিভির এই শুভ ক্ষণে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে শুভ কামনা।

লেখক : সিনিয়র স্টাফ করেসপনডেন্ট, খুলনা