এনটিভি আমার জীবনের স্বপ্নসারথি

Looks like you've blocked notifications!

এনটিভিতে কাটানো সময়ের স্মৃতিগুলো আমার জীবনের সোনালি অধ্যায়। মনে পড়ে এই যেন সে দিন। ২০০৪ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার সময় সংবাদ সংগ্রহের কাজগুলো স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও জ্বলজ্বলে। বন্যাকবলিত মানুষের পাশে গিয়েছি। পানিবেষ্টিত এলাকায় কোনও সময় শরীর ডুবিয়ে, আবার কোনও সময় বৃষ্টিতে ভিজে ক্যামেরা নিয়ে ছোটাছুটির কষ্টগুলো এখন আমার কাছে মধুর স্মৃতি। বন্যাকবলিত মানুষের নানা সমস্যা যখন এনটিভির পর্দায় তুলে ধরেছি, তার প্রচার দেখে সব কষ্ট ভুলে গেছি। আমার পাঠানো সংবাদ প্রচারের পর যখন সমস্যার সমাধান হয়েছে এবং মানুষ উপকৃত হয়েছে, সে সময়টার আনন্দ-অনুভূতি ছিল অন্যরকম। এনটিভিতে বন্যার নানা প্রতিবেদন তৎকালে সবার মাঝে আস্থা-বিশ্বাসের  প্রতীক হিসেবে সবার মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

২০০৫ সালের ঘটনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তে হীরাপুর এলাকায় ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে এক স্কুলছাত্রী নিহত হয়। পরে দুদেশের সীমান্তে সীমান্তরক্ষীদের মাঝে সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। সীমান্ত যুদ্ধ, গোলাগুলি, ভয়-আতঙ্ক থমথমে পরিস্থিতে সেখানে আমি এনটিভির প্রতিনিধিত্ব করি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সপ্তাহব্যাপী এ কাজের অভিজ্ঞতায় এখনও শিহরিত হই। স্কুলছাত্রীর বাড়িতে শোকাহত মানুষের শোক-মাতম, কান্না-আহাজারির সময় এনটিভিকে কাছে পেয়ে মানুষ বিশেষ আপন ভেবেছে। থমথমে অবস্থায় তৎকালীন বিডিআর কালিকচ্ছ ক্যাম্প অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে বিডিআর সদস্যরা সীমান্তে ছিলেন সতর্ক অবস্থানে। সাংবাদিক হিসেবে আমিসহ আরও কয়েক জন ছিলাম তেমনই। গোলাগুলির শব্দ, সীমান্তে সীমান্তরক্ষীদের পতাকা বৈঠক, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সীমান্ত এলাকায় পরিদর্শন পরিস্থিতির নিরসন পর্যন্ত সেই সময়ের প্রতিবেদনগুলো কোনও দিন ভুলতে পারব না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার উপজেলা নবীনগর। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে উপজেলাবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে ২০১৪ সালে এনটিভিতে একটি প্রতিবেদন করি। সেই প্রতিবেদনে সেতু এবং সড়ক যোগাযোগ উন্নত করার দাবি তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যোগাযোগ উন্নয়নে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয় এবং পরে তা বাস্তবায়িত হয়েছে। এনটিভিতে প্রচারের সেই সংবাদটুকু আজও নবীনগর উপজেলাবাসী ভুলতে পারেনি। আমারও মনে তা অম্লান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার পূর্ব ঐতিহ্য কিছুটা ম্লান হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা অফিসের অনুমতি নিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন বিষয়ে কিছু প্রতিবেদন করেছি। এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমার একটি প্রতিবেদন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সেই প্রতিবেদনগুলো সংশ্লিষ্ট মহলসহ জনগণের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন মহলের শুধু ধন্যবাদই নয় সেই সময় আমাকে পুরস্কৃত করা হয়।

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বন্ধনে আমার পাঠানো এনটিভির প্রতিবেদন অনন্য ভূমিকা রেখেছে বলে আমি গর্ববোধ করি। বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ রেল ও সড়কপথে যে যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পনা হচ্ছে এর এই সফলতায় এনটিভি এবং আমি অংশীদার। অন্যদিকে, আখাউড়া স্থলবন্দরের অবস্থা ছিল নাজুক। দুই দেশের আমদানি-রপ্তানির পণ্যবাহী ট্রাক, দুদেশের যাত্রীদের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। ২০০৫ সালের পর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সময়ে স্থলবন্দর, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে প্রতিবেদন করেছি। সেই প্রতিবেদনের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ব্যাপক রেল ও সড়ক যোগাযোগের কাজ পুরোদমে চলছে।

প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ সম্পদের উৎপাদনস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাস, আশুগঞ্জের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সারা দেশেই সরবরাহ হয়। তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, আশুগঞ্জ সার কারখানা, তিতাস গ্যাসের বিভিন্ন ফিল্ডে নানামুখী সমস্যা হয়েছে। সে সব সমস্যাগুলো এনটিভিতে তুলে ধরেছি। বিশেষ করে তিতাস গ্যাস ফিল্ডের লইস্কার বিলে লিকেজ গ্যাস উদগীরণের ঘটনা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় গ্যাস ফিল্ডে গিয়ে কাজ করেছি। বিস্ফোরণ হতে পারে এমন নানা ভয় কাটিয়ে কাজের মুহূর্তগুলো এখন মনে অন্যরকম পুলক দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-বৃষ্টি, টর্নেডো, সারা দেশে নাড়া দেওয়া ঘটনাগুলোর প্রতিবেদন করে জ্বলজ্বলে সাক্ষী হিসেবে কাজ করেছি। এই অধ্যায়গুলো সব সময় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সদর উপজেলার উরশীউড়া, চিনাইর, চান্দিতে বয়ে যাওয়া ২০১৩ সালের ভয়াবহ টর্নেডোর সময় প্রায় মাসব্যাপী দিনরাত অবস্থান করে সেখানকার সংবাদ এনটিভিতে পাঠানো এবং তা প্রচারের মুহূর্তগুলো এখনও স্পষ্ট।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ, প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। দুপক্ষের সংঘর্ষকালে ঘটনাস্থলে অবস্থান করেছি। অভিজ্ঞতার পাতায় সেই মুহূর্তগুলো মনে এখনও সাহস সৃষ্টি করে।

এনটিভিতে কাজ করতে গিয়ে সাহসী হওয়ারও সুযোগ পেয়েছি। সবশেষ ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হলে তিন দিনব্যাপী ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন সরকারি আফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ভাঙচুর ও আগ্নিসংযোগ করা হয়। সে ঘটনায় অনেক নিহত ও আহত হয়, সে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এনটিভিতে প্রতিবেদনের জন্য মাঠে ছিলাম। বেশ কয়েক বার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা ছিল আমার।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ঘটনার সময়ে প্রায় মাসব্যাপী ঘটনাগুলোতে অন্যান্য গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ঢাকা থেকে আসেন। ঢাকা অফিস তখন এনটিভির হয়ে আমাকে কাজ করার সুযোগ দেন। হেড অফিসের যথাযথ নির্দেশনা, পরামর্শ, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। আমার সংবাদগুলো সবার মাঝে বস্তুনিষ্ঠতা, আস্থা, বিশ্বস্ততা এবং গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। এই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনে আমি চিরদিন এনটিভির কাছে কৃতজ্ঞ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া তিতাস নদীর শাখা-প্রশাখায় পানিবেষ্টিত জনপদ। এখানে প্রায়ই ঘটে নদী-দুর্ঘটনা। ২০১১ সালে সরাইল পানিশ্বরে লঞ্চ দুর্ঘটনা ও ২০২১ সালে তিতাস নদীতে নৌকাডুবি; এই দুটি ঘটনায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়। দিনরাত সেখানকার কাজগুলো আমার সাংবাদিকতা-জীবনের অনবদ্য অধ্যায়।

শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এখানকার বিভিন্ন ঐতিহ্য যখন ম্রিয়মাণ, বিভিন্ন ঐতিহ্য যখন বিলুপ্তির পথে, সে সব বিষয়গুলোর খোঁজখবর নিয়ে এনটিভিতে অনেক প্রতিবেদন করেছি। বিশেষ করে সরাইলের আরিফাইল মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাত্রাশিল্প, লোকজ ঐতিহ্যের নানা বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করেছি। প্রতিবেদনগুলো আমার প্রাণের জেলার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা রয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি একটি গণমাধ্যম জননন্দিত, গ্রহণযোগ্য হওয়ার নেপথ্যে কাজ করে সম্মিলিত প্রয়াস। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এনটিভির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী স্যার, সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সংবাদ বিভাগের সুসংগঠিত জনবল সারা দেশে বিস্তৃত নির্ভীক সংবাদকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, দৃঢ় মনোবল ও ঐকান্তিকতায় অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সফল একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনটিভিকে প্রতিষ্ঠিত করতে যাঁরা অবদান রেখেছেন এবং রাখছেন, সবাইকে এই শুভ দিনে অভিনন্দন।

লেখক : স্টাফ করেসপনডেন্ট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া