ঐক্য প্রতিষ্ঠাই হবে বাইডেনের চ্যালেঞ্জ

Looks like you've blocked notifications!

Biden call for a time of healing. ঠিক এমন এক শিরোনাম করেছে সিএনএন। আমেরিকার ভেতর সৃষ্ট ক্ষতের চিকিৎসাকে প্রথম কাজ বলে ঠিক করেছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেই ক্ষত হলো মার্কিন সমাজের বিভাজন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরে আমেরিকাবাসী কী পেয়েছে, সেটা হিসাব করলে কিছু অপ্রিয় কথা উঠে আসবে। ট্রাম্প তাঁর শাসনামলের শুরু থেকেই সাধারণ আমেরিকান নাগরিকদের মধ্যে একটা আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। বর্ণ, জাতি এবং অভিবাসী-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ভয়ংকর রূপ। বারবার হিংসার ঘটনা ঘটেছে, যার জেরে আমেরিকায় ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’-এর মতো আন্দোলনও হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে আমেরিকাকে মুক্তি দিতে পারে বাইডেন-কমলা জুটি। তাই ডেমোক্র্যাটদের পাশাপাশি মার্কিনি ও অভিবাসীদের কাছে এবারের নির্বাচন ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

সিএনএনের বিশ্লেষক যখন মন্তব্য করেন, deeply divided nation, তখন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে বলতে শোনা যায়, the country remains deeply and bitterly divided. এমন বাস্তবতায় জো বাইডেনকে বলতেই হয়, ‘আমি এমন এক প্রেসিডেন্ট হতে চাই যে বিভাজন নয়, ঐক্য চায়, যে লাল বা নীল স্টেটস নয়, যে দেখবে শুধু ইউনাইটেড স্টেটসকে।’ সবচেয়ে বড় কথা, যেটি বাইডেন বলেছেন, তা হলো, তিনি আমেরিকার আত্মাকে ফিরিয়ে আনতে চান। বললেন, গত চার বছর যেসব নিষ্ঠুর শব্দ উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী  সম্পর্কে, সেসব আর যেন না হয়।  মার্কিন ‘মুখ’ হতে চান তিনি। চান সবার প্রেসিডেন্ট হতে। যিনি তাঁকে ভোট দিয়েছেন, যিনি দেননি, প্রত্যেককে সঙ্গে নিয়েই চলবেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালিতে করোনাভাইরাসে দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু, দেশের বেহাল অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভাজন মার্কিন জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছিল বলেই এবার বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছে। তবুও প্রায় অর্ধেক ভোট যখন উন্মাদনার পক্ষে যায়, তখন মার্কিন সমাজের ভেতরে থাকা বিভাজনরেখাকে সহজেই মিলিয়ে দিতে পারবেন বাইডেন, এমনটা ভাবার কারণ নেই।

ট্রাম্প হার স্বীকার করেননি। সহসা করবেন বলেও মনে হয় না। রাজনৈতিক ইস্যু তো বটেই, এমনকি করোনা ইস্যুতেও ট্রাম্পের আচরণ ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ। প্রকাশ্যে সাংবাদিক-বৈঠকে মাস্ক ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনা মনে আছে নিশ্চয়ই।

কট্টর ট্রাম্প সমর্থক ফক্স নিউজ বাইডেনের ঐক্যের ডাককে সমর্থন জানিয়ে বলেছে, কাজটি এত সহজ হবে না। কারণ হিসেবে ফক্স নিউজ বলছে, সিনেটে রিপাবলিকানদের আধিপত্য বেশি এবং সেটা সরকার পরিচালনার সময় আরো স্পষ্ট হবে। নির্বাচনের আগে আমেরিকায় ঘটে গিয়েছে জর্জ ফ্লয়েড খুনের মতো ঘটনা। সে ঘটনার জেরে আমেরিকাতে শুধু নয়, সারা বিশ্বেই বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দেখা দেয়। আফ্রো-আমেরিকান ভোট, ইমিগ্র্যান্টদের ভোট পেয়েছেন বাইডেন। তাই ফক্স নিউজ বলছে, ইমিগ্রেশন ব্যবস্থার সংস্কার আনতে হবে বাইডেনকে।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পরিসরকে ক্রমশ সংকুচিত করে ফেলেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে পুলিশ-রাষ্ট্রে। নাগরিক স্বাধীনতার ওপর নেমে এসেছে একের পর এক খড়গ। নাগরিক স্বাধীনতার প্রথম শর্ত, তার জীবনকে সুরক্ষিত রাখার অধিকার। ট্রাম্পের নানা কাণ্ডে সেই অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছিল।

ট্রাম্প আমেরিকার ক্ষয়ের প্রতীক। সেখান থেকে পুরোপুরি উল্টো পথে যাওয়া সহজ হবে না বাইডেনের জন্য। বারাক ওবামার যুগে নিজ দেশের বাইরেও যে উদার আমেরিকার ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, ট্রাম্প তাঁকে পুরো উল্টে দিয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতিতে ট্রাম্পের চীনবিরোধিতা আগ্রাসী, কিন্তু সেটাতেও কোনো স্পষ্টতা নেই।  Make America Great Again নামের স্লোগান দিয়ে এসে ট্রাম্প আমেরিকাকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন, বিশ্বে তার প্রভাব এতটা কমেছে যে তাকে আর গ্রেট বলা চলে না।

যে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির পরিচয় ট্রাম্প দিয়েছেন, তাকে আদর্শ মানতে শুরু করেছিলেন বিশ্বের অনেক দেশের একই ধাঁচের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক নেতারা। কিন্তু ট্রাম্প যে এত ভোট পেলেন, তাকে কী বলা যাবে? ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার মূল অস্ত্র ছিল বহিরাগত ও অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কখনো বর্ণ, কখনো ধর্মকে ব্যবহার করে একই রকম বিভেদের রাজনীতি প্রকাশ করে তিনি শ্বেতাঙ্গদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সেই জায়গাতেই ঘটেছে আমেরিকার পতন।

৭৭ বছরের জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র বা জো বাইডেনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার বিপরীতে গণতান্ত্রিক উদারতাবাদের আমেরিকাকে বিশ্বের সামনে হাজির করা। মার্কিন সমাজে ট্রাম্প-অভিঘাত বড় গভীর। পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ানটি মৌলিক ও মূলস্পর্শী। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে আমেরিকার মানুষ নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে। জো বাইডেনের জন্য সময়টা চ্যালেঞ্জিং। একদিকে করোনার বিস্তার, অন্যদিকে বর্ণবাদী শাসনে সৃষ্ট দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, উদ্বেগ থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া তাঁর কাজ। চার বছর ধরে মার্কিন জনগণ সমতা ও ন্যায়বিচারের জন্য যে লড়াইটা করেছেন, একজন লড়াকু ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে বাইডেন সেই লড়াইয়ের কী মূল্য দেন, সেটাই দেখার পালা আগামী চারটি বছর।

লেখক : সাংবাদিক