কনজারভেটিভ দলীয় নির্বাচন : কে হচ্ছেন জনসনের উত্তরসূরী?

Looks like you've blocked notifications!

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় তাঁর অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য কনজারভেটিভ পার্টির পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটের দ্বারা প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ার পাঁচ ধাপের ভোটের মধ্যে পঞ্চম ধাপের ভোট শেষে ১৩৭ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাবেক চ্যান্সেলর ঋষি সুনাক। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন পররাষ্ট্রসচিব লিজ ট্রুস। তিনি পেয়েছেন ১১৩ ভোট। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর হবে শেষ ধাপের ভোট। এ দিন ভোট দেবেন টোরি দলীয় সদস্যরা। ডাকযোগে তাঁরা ভোট দিতে পারবেন। এ দিনই নির্ধারিত হবে কে হবেন অবশিষ্ট সময়ের জন্য পরবর্তী কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী।

নির্বাচনি ক্যাম্পেইনের জন্য উভয় প্রার্থী মধ্যবর্তী ছয় সপ্তাহ সময় পাবেন। এ সময়ের মধ্যে তাঁরা টোরী দলীয় সদস্যদের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁদের সামনে নিজস্ব কর্মকৌশল ব্যাখ্যা করবেন এবং ভোটারদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেবেন। প্রার্থীদের নিকট এ মুহূর্তে টোরি ভোটারদের মূল জিজ্ঞাস্য হলো তাঁরা কীভাবে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাবেন? উল্লেখ্য, এ নির্বাচনি দৌড়ের শুরুতে প্রার্থী সংখ্যা ছিল আট। পঞ্চম দফা ভোট শেষে নির্বাচনি দৌড়ে টিকে আছেন মাত্র দুজন। নির্বাচনি দৌড়ে ঋষি সুনাক বরাবর এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে থেকে নাটকীয়ভাবে সামনে চলে এসেছেন লিজ ট্রুস। এ জন্য অনেকে মনে করছেন যে শেষ দফায় তিনিই এগিয়ে যাবেন। অপরদিকে প্রাক-নির্বাচনী বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, প্রথম বারের মতো ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রার্থী হিসেবে ঋষি সুনাকের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি।

ঋষি সুনাকের বক্তব্য হলো, তিনি চ্যান্সেলর থাকাকালীন যে কৌশল নিয়েছিলেন যে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত ট্যাক্স কমাবেন না, সেটিই অব্যাহত রাখবেন। কেননা তিনি মনে করেন, এটি না করলে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। অপরদিকে, লিজ ট্রুস ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড কর হ্রাস করবেন, যাতে করে জনগণের পকেটে অর্থ থাকে। মানে, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাঁর উদ্দেশ্য হলো কনজারভেটিভ মূল্যবোধ ধরে রাখা এবং টোরি সদস্যদের সহায়তা দেওয়া। তবে টোরি সমর্থকদের ধারণা, এটি করতে গেলে সরকারকে বিপুল অর্থ ঋণ করতে হবে। তবে লিজ ট্রুস মনে করেন, তাঁর কর হ্রাসকরণ কৌশলই তাঁকে নির্বাচনি দৌড়ে সামনে নিয়ে এসেছে এবং তিনিই পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে লেবার প্রার্থীকে পরাজিত করার জন্য যোগ্য কনজারভেটিভ প্রার্থী হবেন।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে এবং সে নির্বাচনে কোনও প্রার্থী লেবার দলকে পরাজিত করতে সক্ষম তা-ও আসন্ন নির্বাচনে টোরি ভোটারদের ভোটদানে প্রভাবিত করবে। কেননা ব্রিটিশ আই পোল ট্র্যাকার-এর জনমত জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে কনজারভেটিভ দলের প্রতি জনসমর্থন হ্রাস পাচ্ছে এবং লেবার দলের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে যেখানে কনজারভেটিভ বনাম লেবার পার্টির জনসমর্থন ছিল ৪২(%):৩৬(%)। সেখানে বর্তমানে ২১ জুলাই হয়েছে তার উল্টো, অর্থাৎ ৩২(%): ৪১(%)। সুতরাং কোন প্রার্থী আগামী ২০২৪ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ দলকে টেনে তুলতে পারবে তা-ও টোরি ভোটারদের বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লিজ ট্রুসের কর হ্রাসকরণ নীতিকে ঋষি সুনাক অবাস্তব গালগল্প বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, এটি ভোটারদের মন জয় করার জন্য একটি ধাপ্পা। কেননা এই নীতি বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না এবং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আনতেও সক্ষম হবে না। এ জন্য তিনি সহসা কর হ্রাস না করার নীতিতেই অটল রয়েছেন এবং তিনি মনে করেন এই নীতি অনুসরণের মাধ্যমেই তিনি ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙা করতে সক্ষম হবেন, যা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে লেবার প্রার্থীকে পরাজিত করতে সহায়ক হবে।

গত ২৯ জুন বুধবার কনজারভেটিভ দলের ডেপুটি চিফ হুইপ ক্রিস পিনচার একটি বেসরকারি ক্লাবে গিয়ে অত্যাধিক মদ্যপান করেন এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। ইতোপূর্বে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে কয়েক বছর পূর্বে তিনি দুজন ব্যক্তিকে যৌন হয়রানি করেছিলেন। ফলে কনজারভেটিভ এমপি হান্টরা এ রকম ব্যক্তিকে ডেপুটি চিফ হুইপ নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সমালোচনায় সোচ্চার হন। প্রত্যুত্তরে ডাউনিং স্ট্রিট থেকে জানানো হয় যে ক্রিস পিনচারের অতীত অপরাধের কথা প্রধানমন্ত্রী জানতেন না। পরে প্রমাণ হয়, প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছিল কিন্তু তিনি তা আমলে নেননি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন স্বীকার করেন যে তাঁকে ২০১৯ সালে বিষয়টি অবগত করা হয়েছিল এবং অসত্য বলার জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এপ্রিলে তাঁকে লকডাউন আইন ভঙ্গ করার অপরাধে জরিমানা করা হয়।

ইতোমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়, ফলে সরকার কর বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। ইতোপূর্বে ঘুষ গ্রহণের দায়ে কমনস কমিটি টোরি এমপি ওয়েন পেটারসনকে ৩০ দিনের জন্য বহিষ্কার করলে জনসন নিজ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে তাঁকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন; কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে পেটারসন পদত্যাগে বাধ্য হন। এসব ঘটনাবলি বরিস জনসনের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করে। বরিস জনসন ব্রেক্সিট কার্যকর করতে সক্সম হলেও টোরি এমপিদের অভিযোগ যে তিনি ব্রেক্সিটের আদর্শকে ফোকাস করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জুন মাসে কনজারভেটিভ এমপি হান্ট তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কোনও সততা-আদর্শ কিংবা যোগ্যতা নেই। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জনসন অনাস্থায় উতরে যান, কিন্তু তাঁর সমালোচনা চলতেই থাকে এবং একের পর এক মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাঁর কেবিনেট থেকে পদত্যাগ করতে থাকেন। যখন ৫৯ জন মন্ত্রী-জুনিয়র মন্ত্র পদত্যাগ করেন, তখন সরকারের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গেলে ৭ জুলাই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, দলীয় নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যিনি তাঁর অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হবেন।

এমপিদের ভোটে ঋষি সুনাক এগিয়ে থাকলেও টোরি দলীয় সদস্যদের মধ্যে সুনাকের জনপ্রিয়তা কেমন, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কেননা ব্রিটিশ জনমত খুবই পরিবর্তনশীল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রার্থী নির্বাচনের শুরুর দিকে পেনি মরডান্ট এগিয়ে ছিলেন লিজ ট্রুসের চেয়ে। কিন্তু পঞ্চম দফার ভোটের ক্যাম্পেইনে তাঁর অসংলগ্ন বক্তব্যের কারণেই ভোটাররা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং নাটকীয়ভাবে লিজ ট্রুস এগিয়ে যান। সুতরাং সামনের ছয় সপ্তাহে সুনাক এবং ট্রুস কীভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১৮০,০০০ সংখ্যক টোরিদের মন জয় করেন, তা-ই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : বিভাগীয় সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়