বাজেট ভাবনা

ঘাটতি কমিয়ে সরকারকে খরচের লাগাম টানতে হবে

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে অনেক বড় ঘাটতি বাজেট করেছে বাংলাদেশ সরকার। এখন মূল্যস্ফীতি খুবই কঠিন অবস্থায়। এটা খুব খারাপভাবেই আক্রান্ত করছে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের মানুষকে তো আরও বেশি। যাদের আয়ের স্তর বেশি থাকে, তাদের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও তেমন কষ্ট হয় না। কিন্তু দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখানে প্রভাবিত হবে। সে জন্য বাজেটের ঘাটতি কমিয়ে সরকারকে খরচের লাগাম টানতে হবে। তাছাড়া মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট পলিসি থাকতে হবে।

বাংলাদেশের আরেকটা সংকট ডলারের সমস্যা। তবে এ সমস্যা খুব একটা আছে বলে মনে করি না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যেমন করে দেশের ব্যবসায়ীরা তেলের বোতল বা ড্রাম খাটের নিচে ও গোডাউনে লুকিয়ে রাখে। আর ডলারও এভাবে লুকানো হয়ে থাকে। এটাই ডলার সংকটের অন্যতম একটা কারণ। আরেকটা ব্যাপার হলো যে সামনে জাতীয় নির্বাচন। যখন সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসে, সেই সময় যারা বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে, তারা নিশ্চিত জানে না যে তাদের কী অবস্থা হবে। তখন তারা টাকা-পয়সা সরানোর জন্য আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

শ্রীলঙ্কা ও নেপালসহ বিশ্ব অর্থনীতির একটা সংকট চলছে। এর সঙ্গে করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ জড়িত। পৃথিবীর কোনো দেশই কিন্তু এখন স্বস্তির মধ্যে নেই। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই অস্থিরতা। আর এটার ঢেউ তো সব দেশেই লাগবে। তবে বাংলাদেশের কৃষি খাত অনেক সমৃদ্ধ ও অর্থনীতি অনেক বড়। এ দেশে বিভিন্ন ধরনের ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর রয়েছে। তা না হলে বাংলাদেশ অনেক বিপদের মধ্যে পড়ে যেত। কিন্তু ভবিষ্যতে যে বিপদ ঘটবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

বাজেটে এ ধরনের প্রধান ক্ষেত্রগুলো বিবেচনায় নেওয়া খুবই জরুরি। সরকারের খরচ কমাতে হবে, ঘাটতি বাজেট কমাতে হবে এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক মানি সাপ্লাইয়ে দক্ষ পরিচালনা থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় হলো, আমাদের যে ফুড ও অন্যান্য সাপ্লাই চ্যানেল রয়েছে সেটা যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উৎপাদনের সুস্থ ধারা থাকতে হবে। সেটা আমদানি করে হোক বা দেশের উৎপাদন থেকেই হোক। এখানে যেন খুবই দক্ষ পরিচালনা থাকে।

আরেকটা ঘটনা হলো, নির্বাচন যখন আসে, তখন ক্রান্তিক বছরে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। এটা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য হুমকি। ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে সেটা অর্থনীতিকে খুব ক্ষতি করে। তা অনেকটা ‘বোঝার ওপর সাতের আঁটি’র মতো অবস্থা তৈরি করে। এসব জায়গাতে খুবই সতর্কতার সঙ্গে বাজেট পাস করতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত না হয়। দরকার হলে সরকারের ট্যাক্সের বোঝা কমাতে হবে। করোনায় যে বিপর্যস্ত অর্থনীতি; আঞ্চলিক কর্মকাণ্ড, ছোটখাটো কর্মকাণ্ড আছে এবং ছোট ব্যবসায়ী আছে, তারা যেন আবার কাজে আগের ধারায় ফিরতে পারে। যেন অর্থনৈতিক চাহিদাটা শক্তিশালী থাকে।

আগামী দুই-তিন বছর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অর্ডার নিয়ে খুবই ভালো একটা অবস্থা আছে। এটা ইতিবাচক দিক। আঞ্চলিক অর্থনীতির সাথে ইন্টিগ্রেশন অনেক বেশি আছে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যানেল খোলা রয়েছে। তবে এখানে সবচেয়ে ঝুঁকি হচ্ছে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এর প্রধান হাতিয়ার হলো উৎপাদন ও সাপ্লাই চেইনকে বাধাগ্রস্ত না করা। এখানে কোনো ধরনের সমস্যা হলে ‘ফায়ার ব্যাক’ করবে। ইতোমধ্যে আবারও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। যখনই উৎপাদন, ট্রান্সপোর্ট ও অ্যালিগেশন খরচ বাড়বে তখন সবকিছুরই দাম বেড়ে যাবে। বৈশ্বিকভাবে তেলের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে। এটা তো হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার একটা খেলা। তারা চাচ্ছে যে, রাশিয়াকে সেখানে আটকে দিয়ে দুর্বল করে ফেলবে। যদিও রাশিয়াই যুদ্ধটা শুরু করেছে। কিন্তু ইউরোপিয়ানরা তাকে লক করার চেষ্টা করছে যে যুদ্ধটা আরও দীর্ঘায়িত হলে রাশিয়ার আরও বিপদ হবে। দিনশেষে বিপদ তো সারা বিশ্বেরই হবে। সেই বিপদের তাপের মধ্যে কিন্তু আমরাও রয়েছি। সহজেই সেখান থেকে মুক্তির কোনো রাস্তা নেই। ফলে বাজেটকেই সেখান থেকে মুক্তির রাস্তা দেখাতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মধ্যে তেল ও চাল লুকানোর যেসব ‘ভূত’ রয়েছে, সেগুলোর মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে। যারা সঠিক ব্যবসায়ী রয়েছে, তাদের সঙ্গে নিয়ে অর্থনীতির একটা দক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। বাজেটই সেই রাস্তা দেখাতে পারে। এ ছাড়া সামনের দিকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে আমাদের অর্থনীতি।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থার শেষ নেই। শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এক্সপেরিমেন্ট করছে সরকার। যারা এই দেশের উন্নয়ন করবে, তাদের নিয়ে এত এক্সপেরিমেন্ট করা ভালো দিক কি না, তা নিয়ে তর্ক রয়েছে।

স্বাস্থ্যখাতের সংকট তো করোনা আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, এই দুই সেক্টরই আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু সেখানেই বড় অব্যবস্থাপনা। এসব জায়গায় কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। তার জন্য বাজেটের সঠিক দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। আর মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি ভোগায় গরিব মানুষদের। তাদের যেন আয়-রোজগারের পথ বন্ধ না হয় এবং সে জন্য বাজেটে তার একটা সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। তা না হলে এ মানুষগুলো আরও বিপদে পড়ে যাবে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সবাই বিপদে পড়বে। এখান থেকে কেউ পরিত্রাণ পাবে না।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়