জনতার দাবি আদায়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পিছুটানহীন

Looks like you've blocked notifications!

আজ বাঙালি জাতির সাহসের আইকন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। এই বাংলার মানুষ সারাজীবন ধরে যে বীরত্বের স্বপ্ন দেখে গেছে, একজীবনে বঙ্গবন্ধু তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। শুধু স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে নয়, অনবদ্য সংগ্রামী মানুষ থেকে তাঁর উত্তরণ ঘটেছিল অসামান্য মানবিক দেশপ্রেমিকে।

প্রতি বছর জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে এই দিনটি। কিন্তু এবার তাঁর শততম জন্মদিন আর এই বছরটি পালিত হচ্ছে মুজিববর্ষ হিসেবে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে এবারের মহা আয়োজনকে ছোট করে আনা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ আন্তর্জাতিক অতিথিরা আপাতত আসছেন না। কিন্তু প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির হৃদয়ের আড়ম্বর নিশ্চয় কমেনি।

ছোট্ট করে তাঁর পরিচয় দিতেই হয়। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তাঁদের চার কন্যা ও দুই পুত্রের সংসারে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। সেদিনের টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করা ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ ও জনগণের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধের কারণেই পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। কিশোর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তাঁর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন অবসানের পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধারাবাহিক নানা আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার উপাদানগুলো ছিল একদম স্বতন্ত্র। তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কখনো কোনো একক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কথা ভাবেননি। সমস্ত ধর্ম, ভাষা, জাতি নির্বিশেষে সব মানুষের মুক্তি ও সমৃদ্ধিই ছিল তাঁর স্বপ্ন। সেই লক্ষ্যেই তিনি জীবন বাজি রেখে বারবার সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। আপস নয়, নিরন্তর সংগ্রামই যে পথ, সে কথা নিজের জীবনে বারবার প্রমাণ করেছেন জীবনের বড় সময় জেল-জুলুম খেটে। জনতার দাবি আদায়ে তিনি ছিলেন পিছুটানহীন এবং সে জন্য ঝুঁকিও নিয়েছেন বারবার।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা পড়লে ধারণা করা সহজ হয় তাঁর অসম সাহসী মনোভাব কেন তাঁকে বাঙালির সাহসের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই সাহস ছিল তাঁর মজ্জাগত। আজ চারদিকে অনেক মুজিবভক্ত, অনেক মুজিববন্দনা। কিন্তু মুজিবের মতো সাহস আর সততার বড় অভাব। সাহসের সঙ্গে সত্য উচ্চারণ নেই বললেই চলে।

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি ইউনেস্কো বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। সে রাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দি করে রাখা হয়। সে সময় প্রহসনের বিচার করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্যোগও নেয় পাকিস্তানি শাসকেরা। যদিও পরে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে মনোনিবেশ করেন।

বঙ্গবন্ধু বড় রাজনীতি করেছেন। ক্ষুদ্রতা তাঁর অভিধানে ছিল না কখনো। সত্যিকারের উদার ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিচার না করার এই ভেদভাবহীন মানসিকতা তাঁকে তাঁর সময়ের আর সব বড় রাজনৈতিক নেতা থেকে সব সময় ইতিহাসে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করে আলাদা ভূখণ্ড নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ নির্মিত না হলে কোনোদিনই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে চলা যাবে না। সেই অসাম্প্রদায়িক বিচারধারা এদেশ থেকে হারিয়ে গেল স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে সেনাবাহিনীর একদল পথভ্রষ্ট, বিশ্বাসঘাতক সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে আজ এক নতুন লড়াইয়ে বাংলাদেশ।

আজ যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনীতির ময়দান কাঁপাচ্ছেন, তাঁরা আগে কতটা সেই মানুষকে নিয়ে কথা বলার যোগ্য, সেটা নিয়ে ভাবলে উপকার হবে বেশি। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পেছনে ফেলে গেছেন তাঁর আন্তরিকতা, মানবিকতা আর দেশ কল্যাণের মহান আদর্শ। আজ হিংসা-দ্বেষ-দীর্ণ সমাজে তাই তাঁর মানবিক দর্শন বিশেষভাবে অনুসরণযোগ্য।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা