ঢাকায় স্বপ্নের মৃত্যু

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশে গ্রাম থেকে বহু মানুষ তাদের স্বপ্ন নিয়ে শহরে যায়। পছন্দনীয় শহরগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকা অন্যতম। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা শহরে বাস করে দুই কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার ৮৬০ জন। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের মেগাসিটি বা বৃহৎ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কিত অবকাঠামোগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় বহু মানুষ ঢাকায় অভিবাসন করে। কেউ শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে, কেউ বড় অফিসে চাকরির স্বপ্ন নিয়ে, কেউ মিডিয়ায় পেশা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং কেউ শুধু বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমায়।

নিঃসন্দেহে বহু নারী ও পুরুষ ঢাকায় তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। গ্রামের বেকার পুরুষ ঢাকায় গিয়ে কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছে। ঢাকায় তারা নতুন ঠিকানা পেয়েছে। যেমন—বন্যা ও নদীভাঙন-কবলিত অঞ্চলের বহু মানুষ ঢাকায় গিয়ে উপার্জন করে আত্মনির্ভরশীল হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত রেখেছে গ্রামের দরিদ্র ও অসহায় নারীরা। তারা ঢাকায় অবস্থিত পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ করে নিজেকে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। তাদের পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করতে পেরেছে। বহু মানুষের জীবনের সফলতা ও সচ্ছলতার সঙ্গে ঢাকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হয়তো সে কারণেই বলা হয়ে থাকে, ‘ঢাকায় টাকা ওড়ে’।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের বা নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষের জীবনে ঢাকা শহরের প্রভাব কতখানি, তা স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে যখন করোনা-দুর্যোগ মোকাবিলায় ঢাকা শহরকে এই বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহে শাটডাউনের আওতায় আনা হয়েছিল। বহু শ্রমিক বা দিনমজুর ঢাকায় যেতে পারেনি এবং ফলে তারা উপার্জন করতে পারেনি। আবার যারা ঢাকায় অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কাজ করে উপার্জন করে, তাদের আয় কমেছে। যেমন—বাসচালক, গৃহপরিচারিকা, ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং এ রকম আরো অনেকে তাদের স্বল্প আয় দিয়েই ঢাকায় বাস করে আরো বড় কিছু করার স্বপ্ন লালন করে। এরূপ পেশাজীবীদের আয় নিম্নমুখী, কিন্তু ঢাকা শহরে জীবন নির্বাহ করার ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী। ফলে বহু মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে।

এ রকম উদাহরণ বহু পাওয়া যাবে, ফুটপাতে বা বাসস্ট্যান্ডের একজন চা বিক্রেতা তার স্বল্প আয় দিয়ে বস্তিতে থেকে সংসার চালাচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে টাকা জমিয়ে বড় দোকান ভাড়া নেবে ও ব্যবসা বড় করবে। স্বল্প আয় দিয়ে কষ্ট করে ছেলেকে কলেজে পড়াচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে ছেলে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করবে আর তার অভাবের জীবন শেষ হবে। কিন্তু করোনা-দুর্যোগ এ রকম বহু মানুষের স্বপ্নকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক নির্দেশনার কারণে জনসমাগম কমে গেছে। চা বিক্রেতার মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। তাদের আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে ঢাকার মতো ব্যয়বহুল শহরে থাকা দুঃসাহসের শামিল।

ঢাকা শহরে বহু শিক্ষিত যুবক আছে, যারা মাস্টার্স পাস করার পরও আনুষ্ঠানিক সেক্টরে চাকরি পায়নি। তারা প্রাইভেট-টিউশনি করে অথবা কোচিং সেন্টারে ক্লাস করে জীবিকা নির্বাহ করছে। সেই সঙ্গে চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। চাকরির পরীক্ষার জন্য কোচিংয়ে ক্লাস করছে। স্বল্প আয় দিয়ে কয়েকজন মিলে বাসাভাড়া নিয়ে থাকছে। স্বপ্ন দেখছে একদিন কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি পাবে। কিন্তু করোনাজনিত ভোগান্তির কারণে তাদের আয়ের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে শহরে থাকার স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নতে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, ঢাকায় বহু এলাকায় বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ভাড়াটিয়ারা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে বা স্বল্প আয়ে যেখানে থাকা যায় সেখানে চলে যাচ্ছে। প্রতীয়মান হচ্ছে যে— ১.ঢাকায় বসবাসকারী নিম্ন আয়ের মানুষদের যথেষ্ট সঞ্চয় নেই, যা আপৎকালীন সময়ে ব্যয় করা যায়। ২. ঢাকায় বাসাভাড়া দেওয়া বা পাওয়ার বিষয়টি কোনো সুনির্দিষ্ট বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অধীনে নেই। এরূপ অব্যবস্থাপনার কারণে বহু মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়