তোমার এখন অন্য কোথাও বাড়ি

Looks like you've blocked notifications!

আমাদের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আফসার আহমদ। আজ অন্য এক বাড়িতে চিরকালের জন্য অধিষ্ঠিত হলেন স্যার। দয়াদয় প্রভু তাঁকে মহিমান্বিত মর্যাদা দান করুন। অতল শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা প্রিয় স্যার। মিষ্টি করে চিকন গলায় কেউ আর বলবেন না, ‘ফারদিন তোমার লেখা আমি পড়ি। লিখে যাও।’

আহা রে মানবজীবন। জীবন এত ছোট ক্যানে? টক মিষ্টি ঝালে মোড়ানো সম্পর্ক ছিল আমাদের। আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্যার প্রয়াত হওয়ার পর বিভাগের হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। আমরা অহংকার করে বলতাম, বিশ্বসাহিত্য কিংবা বাংলা নাটকের হাজার বছরের বহমানতা একাডেমিক্যালি বুঝিয়ে বলবার মতো আমাদের একজন শিক্ষাগুরু ছিলেন।

গেল ৩ মার্চ আফসার স্যার সর্বশেষ ফেসবুকে লিখেছিলেন—

তোমার এখন অন্য কোথাও অন্য শহর

বাড়ি,

অফিসফেরৎ বাসস্টপেজে দেখা

অকস্মাৎ

মন ছুটে যায় থমকে থাকে বাড়ানো দুই

হাত;

তোমার আমার মাঝখানে আজ ভয়াল

মহামারি।

চিরায়ত অন্য বাড়ির আহ্বান স্যার কি তবে আগেই অনুভব করতে পেরেছিলেন। প্রাজ্ঞজনেরা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাপ্রাপ্তও হন। জীবনদাতা তাঁদের সেই বরটা দিয়েই রাখেন।

নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের আমাদের মাস্টার্সের ড্রামাটার্জি কোর্সগুলোর তত্ত্বাবধায়ক সেলিম আল দীন স্যার মাঝপথে প্রয়াত হওয়ার পর আফসার স্যার আমাদের দায়িত্ব নেন। স্নাতকোত্তর কোর্সের সবিশেষ অবদানটুকু স্যারেরই। কতশত কথা জমিয়ে রেখেছি স্যার। কিছুই যেন বলা হলো না।

এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সাড়ম্বরে স্যারের ৬২তম জন্মদিন পালিত হলো। আমাদের বিভাগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্যারকে সহাস্যে ‘শুভ জন্মদিন’ বললাম। আজ স্যার আমাদের মাঝে নেই। এই শোক নেওয়া যায় না। এই দুঃখ বইবার মতো শক্তি আমাদের নেই।

লেখক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, নাট্য নির্দেশক এবং তুলনামূলক সাহিত্যের প্রাজ্ঞ সমালোচক এসব বহুবিচিত্র পরিচয়ের বাইরে এসে তিনি কেবলই আমাদের মহান দীক্ষা ও শিল্পগুরু। বিশ্ববীক্ষার অগ্রনায়ক। স্যারের পিতৃস্নেহটুকু আমরা জীবনভর বয়ে বেড়াব।

আজন্ম মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অনুবর্তী স্যার জীবনের শেষবেলায় বেশ কিছু অনুগল্পে দেশমাতৃকার বন্দনা করেছেন।

গেল ২ জানুয়ারি স্যার ‘পদ্মাসেতু ও সুশীল বৃত্তান্ত’ শীর্ষক অনুগল্প-৪-এ এমনটা লিখেছেন।

এক ধনবান জোতদার তাঁর ঋণগ্রহীতাকে বলল, ‘গরিবের ছেলের এত লেখাপড়া দরকার নাই।’ তার পরেও গরিব মানুষটি কষ্ট করে ছেলেকে পড়ালে জোতদার বলে, ‘পাস দিয়েছে ঠিক, কিন্তু চাকরি পাবে না।’ পাস করার পর গরিবের ছেলের চাকরি হলে জোতদার বলে, ‘চাকরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু বেতন পাবে না।’ গরিবপুত্র মাসের শেষে চাকরির বেতন পেলে জোতদার বলে, ‘হুম, বেতন পেয়েছে; কিন্তু দেখবা টাকা জাল। বাজারে চলবে না। অপেক্ষা করো।’

গরীব তার ছেলের বেতনের টাকায় পাঁচ গাঁয়ের মানুষকে দাওয়াত খাওয়ালে জোতদার বলে, ‘খোঁজ নিয়া দেখো ওই টাকা ছেঁড়া ও ময়লা ছিল। ময়লা টাকায় আর কী-ই বা খাওয়াতে পেরেছে। চিন্তা কোরো না গরিবের চাকরি বেশি দিন টিকবে না।’

অন্তর্পাঠ : তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশ হয়ে বিশ্বব্যাংকের টাকা না নিয়ে নিজের অর্থনৈতিক শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের যে সাহস দেখিয়েছেন, এই দেশের তথাকথিত কিছু সুশীল তার কোনও প্রশংসা না করে নিন্দা করেছিলেন। অথচ নিন্দুকের চোখের সামনে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তব।

আফসার আহমদ স্যার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনামের সাথে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল শিক্ষক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থেকে শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। অমায়িক ও মাধুর্যময় ব্যবহারে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আপনজন হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলেছিলেন।

এমন একদিন নিশ্চয়ই আবার আসবে। আপনার পাশাপাশি হেঁটে যাব অন্য এক জাহাঙ্গীরনগরের পথ ধরে। সেদিন আবার কথা বলব শিল্পের নিপুণ কুশলতা নিয়ে। কথা বলব মানবীয় বিদ্যার অত্যুঙ্গ ধ্যান ও সাধনা নিয়ে। আপনার প্রশ্রয় ও সাহচর্যের অপেক্ষমাণ তালিকায় এই শিষ্যদেরও রেখে দেবেন স্যার। রাবীন্দ্রিক নৈবদ্যে আমরাও আকাশপানে হাত তুলে রাখলাম—

তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে,

এ আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে॥

যত সব মরা গাছের ডালে ডালে

নাচে আগুন তালে তালে রে,

আকাশে হাত তোলে সে কার পানে॥

লেখক : সাংবাদিক