দুঃস্বপ্নের নাম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

Looks like you've blocked notifications!

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ—সীমিত ফরম্যাটের এই মেগা ইভেন্ট বাংলাদেশের কাছে এখন শুধুই দুঃস্বপ্ন। বিগত আসরগুলোতেও এই টুর্নামেন্ট থেকে খালি হাতে বিদায় নিয়েছিল বাংলাদেশ। ব্যতিক্রম হলো না এবারও। ব্যর্থতায় মোড়ানো টুর্নামেন্ট শেষে শূন্য হাতে ফিরেছে লাল-সবুজের দল।

অথচ এই আসরেই বাংলাদেশ দলকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। কেউ স্বপ্ন দেখেছে সেমিফাইনাল খেলার, কেউ বা স্বপ্ন দেখেছে ফাইনাল নিয়েও। কিন্তু টুর্নামেন্ট শেষে যদি প্রশ্ন করা হয়, এবারের বিশ্বকাপ থেকে আসলে কী পেল বাংলাদেশ? চট করে বলে দেওয়ার মতো কোনো উত্তরই পাওয়া যাচ্ছে না। আপাতত উত্তর মনে হচ্ছে একটাই—ব্যর্থতা, ব্যর্থতা এবং ব্যর্থতা!

কিন্তু ভুলটা আসলে কোথায়? বিশ্বকাপের আগে কী হয়নি? পর্যাপ্ত ম্যাচ প্রস্তুতি, টানা সিরিজ জয়ের আত্মবিশ্বাস, ভেন্যুগুলোতে আগেভাগে গিয়ে অনুশীলন কিংবা প্রস্তুতি ম্যাচ—কোনো কিছুতেই ঘাটতি ছিল না বাংলাদেশের। তাহলে সেই ফলটা আসলে কোথায়?

শুরুতেই গলদ

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই বিব্রতকরভাবে হারে বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ রানের ওই হার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশের ব্যাটিং দুর্বলতা। ওই ম্যাচে শুধু মুশফিকের ব্যাট থেকে আসে ৩৮ রান। বাকিরা সবাই ব্যাটিং নিয়ে ভুগেছেন। পরের দুই ম্যাচে ওমান ও পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে জিতে কোনোমতে মূল পর্বে গেলেও শুরুর ম্যাচের ব্যাটিং ব্যর্থতার গলদ ঠিকই পিছু নিয়েছিল বাংলাদেশের।  

সমালোচনা ও অতি আবেগ

স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হারের পর বাংলাদেশ দলকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। কিছুটা চাপ আসে বোর্ডের পক্ষ থেকেও। এই দুটি জিনিস চেপে বসে ক্রিকেটারদের ঘাড়ে। তাই ওমানের বিপক্ষে জয়ের পরই সমালোচনার জবাব দিয়ে ফেলেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। পরের ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে সেই উত্তাপ আরও বাড়িয়ে দেন দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম। সমালোচনার জবাবে তিনি সবাইকে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে বলেন। যে আয়না দেখার ট্রলে এখনো ছেয়ে আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যদিও টুর্নামেন্ট শেষে দলের অধিনায়ক নিজেই জানিয়েছেন, ওমানের বিপক্ষে জিতে আবেগে সেদিন কথাগুলো বলে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। মানুষ চাইলেই তো আর পাল্টাতে পারে না।

নিত্যসঙ্গী ব্যাটিং ব্যর্থতা

পুরো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী ছিল ব্যাটিং ব্যর্থতা। অথচ বাংলাদেশের একাদশে ব্যাটসম্যান ছিলেন আটজনের মতো। কোনো ম্যাচে নয়জনও। কিন্তু এত ব্যাটসম্যান থাকা সত্ত্বেও ব্যাটিং নিয়ে সবচেয়ে ভোগা দল বাংলাদেশ। কেউ টেস্টের মেজাজে খেলেছেন, কেউ আবার আশা জাগিয়ে ফিরেছেন ড্রেসিং রুমে। মারের খেলায় ডট দিয়েই বেশি সময় পার করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। ডটের সংখ্যা ম্যাচের পর ম্যাচ বাড়তেই দেখা গেছে বাংলাদেশের। সুপার টুয়েলভে প্রথম ম্যাচে ডট ছিল ৩৩টি, পরের ম্যাচে ইংলিশদের বিপক্ষে সেটি হয় ৫২টি, শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ১২০ বলের খেলায় বাংলাদেশের ডট বলের সংখ্যা ৫২। ডট বলের খেলায় মেতে থাকা বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের বাউন্ডারিও ছিল হাতেগোনা।

আর টি-টোয়েন্টির মঞ্চে স্ট্রাইক রেট বলে যে একটা কথা, সেটা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। পুরো টুর্নামেন্টে সবচেয়ে আলোচিত লিটন দাসের স্ট্রাইক রেট দেখলে যে কেউই আঁতকে উঠবেন। আট ম্যাচে ১৩৩ রান করা লিটনের স্ট্রাইক রেট মোটে ৯৪.৩২। আরেক টপ অর্ডার সৌম্য সরকার ৪ ম্যাচে করেছেন ২৭ রান, স্ট্রাইক রেট ১০০।  দেড়শর বেশি বল খেলা নাঈম দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ১৭৪ রান করেছেন। তাঁরও মাত্র ১১০.৮২।

পাওয়ার ছাড়া পাওয়ার হিটিং

পাওয়ার হিটিংয়ের খেলায় বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের ব্যাটেই ছিল না পাওয়ার। পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পাওয়ার হিটিংয়ে দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। পাওয়ার না থাকায় স্কিল দিয়ে অভাব মুছতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু সেটাতেও যে দুর্বলতা আছে, তা-ও ফুটে উঠেছে। কীভাবে গ্যাপ খুঁজে বাউন্ডারি নিতে হবে, উদ্ভাবনী শট কেমন হবে, কীভাবে রান তুলতে হবে, কখন কী শট খেলতে হবে কিংবা পাওয়ার প্লেতে কী করা উচিত—সবই যেন ভুলে গিয়েছিলেন তারা। 

প্রতিটি ম্যাচেই পাওয়ার প্লেতে উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি পাওয়ার প্লেতে সবচেয়ে বেশি উইকেট হারানো দলটাও বাংলাদেশ। কি টপঅর্ডার, কি মিডঅর্ডার—কোনো বিভাগই বাংলাদেশকে ভালোকিছু দিতে পারেনি। পুরো টুর্নামেন্টে চরম ব্যর্থ ছিলেন হার্ড হিটার মানা আফিফ হোসেন। প্রত্যাশিত রান পাননি সাকিব আল হাসানও। মাহমুদউল্লাহ কিছুটা পেলেও দলের জয়ের জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল না। 

শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও দুর্বল ফিল্ডিং

পুরো টুর্নামেন্টে ম্যাচ জয়ের তাড়না খুব একটা চোখে পড়েনি বাংলাদেশ দলের। ম্যাচের শুরুতেই দ্রুত উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যাওয়া, কঠিন মুহূর্তে চাপ ধরে রেখে ব্যাটিং কিংবা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, সব ছিল ভুলে ভরা। আর ক্যাচ মিসের মহড়ার কথা এত দিনে সবার জানা। যার জন্য শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জেতা ম্যাচে হেরে যাওয়ার গল্প লিখতে হয়। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ মিস করা দলটার নামও বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে ১১টি ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন বাংলাদেশের ফিল্ডাররা।

উইকেট বোঝার মানসিকতা

এটাতে অবশ্য ক্রিকেটারদের দোষ দেওয়া যায় না। বছরের পর বছর রাজধানী মিরপুরের শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মন্থর উইকেটে খেলে সেই অভ্যাসই গড়ে উঠেছে ক্রিকেটারদের। উইকেট বুঝে বড় শট খেলার রসদও তাই বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে তাঁদের।  

ধারহীন বোলিং

বিশ্বকাপের আগে বোলিং বিভাগে সবচেয়ে বেশি আশা ছিল মুস্তাফিজকে নিয়ে। কিন্তু টুর্নামেন্ট শেষে সেই মুস্তাফিজই হলেন হতাশার নাম। ঘরের মাঠে পারফরম্যান্স কিংবা আইপিএল খেলার সুবিধা—কোনোটাই কাজে আসেনি। বল হাতে নিষ্প্রভ ছিলেন বাঁহাতি পেসার। ধারবিহীন কাটার দিয়ে পারলেন না প্রতিপক্ষের আতঙ্ক হতে। অবশ্য এর জন্য টানা খেলার ক্লান্তিও কোনো অংশে কম দায়ী ছিল না। বোলিং বিভাগে বলার মতো নাম শুধু তাসকিন আহমেদ। গতির বোলিংয়ে তিনিই কেবল ধরে রেখেছিলেন ধারাবাহিকতা। জ্বলে ওঠার আগেই ইনজুরিতে নিভে গেছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। তাঁর বদলে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে দলে ঢোকা রুবেল হোসেনও পুরো টুর্নামেন্টে ছিলেন দর্শক হয়ে। সাকিব কিছুটা ভালো করলেও ইনজুরি তাঁকেও দূরে ঠেলে দেয়।   

এত ব্যর্থতায় ভরা বিশ্বকাপ নিয়ে শঙ্কিত ক্রিকেটাররাও। অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছেন না তাঁরা। যেমনটা অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ শেষ দিনে বলে দিয়েছিলেন, অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তাঁরা। প্রশ্নের উত্তর মাহমুদউল্লাহ নিজেই জানেন না। নিজেদের পারফরম্যান্স নিয়ে এক বাক্যে অধিনায়ক বলেছেন, ‘আমরা বাজে খেলেছি, যেভাবে ব্যাটিং করেছি সেটা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।’

অধিনায়কের এই বক্তব্য শুনে একটি কথা মনে পড়ে গেল—‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা।’

হতাশার বিশ্বকাপের পরেও দিন শেষে আশা বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। নিজেদের ক্ষতগুলোতে মলম লাগিয়ে ফের বাইশ গজে জয় উপহার দেবেন সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা।

লেখক : সাংবাদিক