পদ্মা সেতু

দুই যুগের প্রতীক্ষার অবসান

Looks like you've blocked notifications!

আজ পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হচ্ছে। এতে প্রায় দুই যুগের অপেক্ষার অবসান হবে। ঢাকা বিভাগের দক্ষিণ-পশ্চিমের সর্বশেষ জেলা গোপালগঞ্জ। এ জনপদের অধিকাংশ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে পদ্মায় লঞ্চ-ফেরিতে চলাচলে যে ভোগান্তির শিকার হতো, তা থেকে মুক্তি পাবে। কৃষিনির্ভর অবহেলিত এ জনপদে বিনিয়োগ বাড়বে। গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা। ফলে এ অঞ্চলে অর্থনীতির এক নতুন দ্বার উন্মোচন হবে।

পদ্মা বহুমুখী সেতুটি চালু হলে এ জেলার মানুষ দ্রুত সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে। দিনের কাজ দিনে শেষ করে ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরতে পারবে। মোটরযান শ্রমিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানযটে পড়ে থাকতে হবে না। সাথে সাথে বাড়তি আয়-রোজগার হবে। ঘাটগুলোতে বন্ধ হবে চাঁদাবাজি।

কৃষক তাঁর উৎপাদিত শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ-ডিমসহ অন্যান্য কাঁচামাল খুব সহজেই ঢাকায় পাঠাতে পারবেন। এতে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাবে। রাজধানীসহ উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগও সহজ হবে এ জেলার মানুষের। আর যোগাযোগ সহজ হলে এ অঞ্চলে বিনোয়োগ বাড়বে। নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে। এতে হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান হবে। জীবনযাত্রার মান বদলে যাবে এ অবহেলিত জনপদে।

আগে ঢাকায় যেতে সময় লাগত ৪-৫ ঘণ্টা। মাঝে মাঝে ফেরি-লঞ্চ পারাপারে পড়তে হতো নানা বিড়ম্বনায়। ফলে মানুষের হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হতো লঞ্চ ও ফেরিঘাটে। কোনও দুর্ঘটনায় কবলিত রোগীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে একই ধরনের সমস্যায় পড়ত রোগীর স্বজনেরা। হতাহত এবং অসুস্থ রোগীকে ঘাটে অপেক্ষারত অবস্থায় প্রাণ হারাতে হতো। আর সে ধরনের বিড়ম্বনায় আর পড়তে হবে না। পারাপারের টোলকে সহনশীল রেখে পদ্ম বহুমুখী সেতুটি চলাচলে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন এ জেলার সাধারণ মানুষ।

পদ্মায় সেতু চালু হওয়ার পরে অঞ্চলে ব্যবসার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। মংলা বন্দরকে ব্যবহার করে এ জেলাসহ কয়েকটি জেলার ব্যবসায়ীরা সহজেই মালামাল আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে।

১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করে। সে বছর থেকেই সেতু নির্মাণের আশা তৈরি হয়। সে আশা দুই যুগ পরে পূরণ হতে চলেছে। এ জন্য অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করছেন।

গোপালগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী জিন্নাত আলী বলেন, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাসহ সারা দেশের ৩৬ কোটি চোখ এখন পদ্মা সেতুর দিকে। দেশের প্রথম দ্বিতল সেতুতে চড়তে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে লাখ লাখ উৎসুক জনতা, যারা উদ্বোধনী দিনেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চায়।

পদ্মার এ পাড়ে  দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১টি জেলার কয়েক কোটি মানুষের উৎসবের সাথে যোগ দিচ্ছেন গোপালগঞ্জের মানুষ, কেউ যোগ দিচ্ছেন সরাসরি, কেউ বা টেলিভিশনের পর্দায় বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ যেন বাঙালি জাতির এক মহামিলনমেলার উৎসব।

জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে উন্নয়নের ধারায় যুক্ত করা। সে লক্ষ্যে ১৯৭২-৭৩ সালে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য ঢাকা-খুলনা বিশ্বরোডের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। সে সময় জাপান সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু উন্নত যোগাযোগের কথা চিন্তা করে পদ্মায় সেতু নির্মাণের জন্য জাপান সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেই থেকে জন্ম নেয় পদ্মা সেতুর স্বপ্ন।

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সাথে পদ্মার এ পাড়ের জেলাগুলোর সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা  তৈরির মূল লক্ষ্য ছিল জাতির পিতার স্বপ্নে, যা অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের অন্য সব জেলার মতো গোপালগঞ্জ জেলার মানুষ, উন্নয়নের ধারায় একত্র করা। কিন্তু আজও গোপালগঞ্জে এ পর্যন্ত  গড়ে ওঠেনি কোনও শিল্পকারখানা। এবার অবহেলিত গোপালগঞ্জে গড়ে উঠবে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা। বাড়বে কর্মসংস্থান, ঘুচবে বেকারত্ব।

জেলাবাসীর সব সময়ের দাবি একটাই, গোপালগঞ্জে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে উঠুক আর এসব কারখানাতে শ্রম দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হোক, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাক জেলাবাসী। ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জে গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কারখানা এসেনসিয়াল ড্রাগস, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ, শেখ রেহানা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কোটালীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু দারিদ্র বিমোচন ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, টুঙ্গিপাড়ায় বিআরটিসির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং শেখ রাসেল দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।

পদ্মা সেতু খুলে দিতেই বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ্য-উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের মাঝে।

আমরা জাতি হিসেবে গর্বিত, গোপালগঞ্জের মানুষ হিসেবে সৌভাগ্যবান। যে জেলায় জাতির পিতার জন্ম, আমরা সেই জেলার মানুষ। স্বাধীনতা পরবর্তী গোপালগঞ্জসহ পদ্মার এ পাড়ে কোনও উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। অবহেলিত গোপালগঞ্জে ভালো কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে থাকে গোপালগঞ্জে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে দরকার উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন। সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে গোপালগঞ্জকে দেশের অন্যান্য জেলার সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত তৈরি হলো।

গোপালগঞ্জ বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি শেখ মোশারফ হোসেনের বলেন, আমরা সারা জীবনই অবহেলিত। জাতির পিতাকে হত্যার পর আর আমাদের গোপালগঞ্জে উন্নয়ন করেনি কোনও সরকার। সবাই এ জেলাকে দেখেছে অন্য চোখে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাদের এলাকায় লাগে উন্নয়নের ছোঁয়া। পদ্মা সেতু চালুর পর এ এলাকায় লাগবে আরও উন্নয়নের ছোঁয়া। আশা করি নতুন নতুন উদ্যোক্তা আসবে, গড়ে উঠবে বড় বড় শিল্পকারখানা, বাড়বে কর্মসংস্থান এলাকা ছাড়াও বেকারত্ব ঘুচবে এবং জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে আমাদের এলাকা।

তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর আমাদের অঞ্চলে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠবে, এতে একদিকে দক্ষিণাঞ্চলে বেকারত্ব দূর হবে, অন্যদিকে গার্মেন্টস মালিকেরা কম খরচে শ্রমিক পাবে। কারণ, আমাদের অঞ্চলের শ্রমজীবীদের অধিকাংশ এক মৌসুম কাজ করে পরে অলস সময় পার করে। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে ওই সব শ্রমিক কাজ করতে পারবে। এতে ব্যবসায়ীদের গতি বৃদ্ধি পাবে এবং নতুন নতুন উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে।

এ ছাড়া সেতু চালু হলে আমাদের অঞ্চল হবে অর্থনৈতিক জোন। সরকারি ইপিজেডসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ইতোমধ্যে অনেক কোম্পানি জমি ক্রয় করছেন কারখানা তৈরির উদ্দেশ্যে।

লেখক : স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, গোপালগঞ্জ, এনটিভি