পদ্মায় আটকে দাদিকে শেষ দেখা দেখতে পারিনি

Looks like you've blocked notifications!

বেশ আগের কথা। ঘুম থেকে উঠেই খবর পেলাম, ভোরে দাদি মারা গেছেন। যে দাদির কোলে আমার ছোট্টবেলা কেটেছে, সেই দাদির মৃত্যুর খবর নিতে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখে পানি দিয়েই রওনা দিলাম। সময়, সকাল সাড়ে ৭টা। উদ্দেশ্য—ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা।

রোববার, সকাল ৮টা। রাজধানীর কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে এসপি গোল্ডেন লাইনের একটি বাসে উঠলাম। বাস ছাড়ল। আব্বাজান-মা বারবার কল দিয়ে জানতে চাচ্ছেন, এখন কোথায়; আর কত সময় লাগবে পৌঁছাতে।

এর মধ্যে দাদির নানা স্মৃতি বারবার চোখ ভেজাচ্ছিল আমার। এসব ভাবতে ভাবতে আমার মনে হচ্ছিল—বাসের চাকা যেন চলছে না। সময় তখন সোয়া ১০টা। বাস পৌঁছাল মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটের বাসের সারিতে।

কিন্তু, বিপত্তি বাঁধল তখনই। রাস্তার জটে সারি সারি অনেক বাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ কপালে ওঠে। বাস থেকে নেমে এক ভ্রাম্যমাণ ডিম বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম, ‘এখান থেকে ঘাট কতদূর?’

নাম না জানা ওই ডিম বিক্রেতার উত্তর, ‘মাত্র পাঁচ কিলোমিটার! বাসে বসে একটা বড় ঘুম দেন। পৌঁছাতে সময় লাগবে।’ অর্থাৎ, টানা পাঁচ কিলোমিটার বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি।

ডিম বিক্রেতার কথা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না এলো। অবশ্য তখন কান্না ছাড়া আমার কিছুই করার ছিল না। কারণ, সব বাসকে পেছনে ফেলে আমার চড়ে বসা বাসটি যে আগে যেতে পারবে না। এভাবে চোখের জলে ঘণ্টাদুয়েক কেটে গেল।

কিন্তু, বাস যেন নড়ছে না। মনে হচ্ছিল—ফেরিঘাটে কিছু একটা হয়েছে। নতুবা বাসের চাকা নড়বে না কেন? এদিকে, আব্বাজান বারবার কল দিয়ে জানতে চাচ্ছেন, ‘আর কতদূর?’

না, আর বাসে বসে থাকতে ইচ্ছে করল না। বাস থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম। ফেরিঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরও বেশ খানিক সময় কেটে গেল। এভাবে ফেরিতে ওঠে দৌলতদিয়া পার হয়ে একটি লোকাল বাসে চড়ে বসলাম। সময় তখন প্রায় দুপুর দেড়টা। বাস ছাড়তে ছাড়তে আরও ২০ মিনিট কেটে গেল। অবশেষে বাসটি ছাড়ল।

এভাবে রাজবাড়ী পার হয়ে ফরিদপুরের মধ্যে দিয়ে মাগুরার বুক চিরে যখন বাসটি যশোর পৌঁছাল, তখন সময় বিকেল সাড়ে ৫টা। আকাশে ভীষণ মেঘ। বৃষ্টি শুরু হয়েছে কেবল। আব্বাজান ফোন দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে সবাই? হুজুর বলছেন—সন্ধ্যার আগেই দাফন করতে হবে। এখনি বৃষ্টি শুরু হবে। বৃষ্টি শুরু হলে দাফন করতে ঝামেলা হবে।’

আব্বাজানের কথা শুনে আমার কিছুই বলার ছিল না। স্রেফ ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অন্যদিকে, বাস্তবতা ভিন্ন। দাদি দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে, সৃষ্টিকর্তার ডাকে তিনি সাড়া দেন। তাঁকে বেশিক্ষণ রাখাও ঠিক হচ্ছে না বলে আমারও মনে হচ্ছিল। কিন্তু, মন মানছিল না। আমার বাড়ি যেতে এখনও প্রায় দুঘণ্টা সময় লাগার কথা।

আমি জানি, সেই দুপুর থেকে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি গেলেই দাফন সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু, একদিকে বৃষ্টির বাগড়া। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন অসুস্থ এক ব্যক্তির লাশ আর কতক্ষণই-বা রাখা সম্ভব।

আব্বাজানের ফোনটি কেটে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। বসে পড়লাম। এ ছাড়া যে আমার কিছুই করার ছিল না। আব্বাজানকে আবার ফোন দিলাম। বললাম, দাফন করে ফেলুন। শুধু আক্ষেপ থেকে গেল, আমি আমার দাদিকে শেষ বারের জন্যও দেখতে পেলাম না! অথচ, কত চেষ্টাই না করলাম। হলো না, হলো না; এবং হলোই না!

এসব ভাবতে ভাবতে বারবার মনে হচ্ছিল, আবার ঢাকায় ফিরে যাই। কোনোক্রমেই আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু, বিষয়টি ভালো দেখাবে না। ফলে, বাড়িতে গেলাম। তবে, অনেক রাত হলো। যখন প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওই আক্ষেপ আমাকে আজও পোড়ায়। দাদিকে এখনও দেখতে বড্ড ইচ্ছে করে।

আজও আমার আক্ষেপটি থেকে গেছে। দাদির মুখটি শেষ বারের মতো দেখতে না পাওয়ার স্মৃতি বারবার চোখে ভাসে। কিন্তু, আজ মনটা হালকা লাগছে। ভেবে ভালো লাগছে, ফেরি পারাপারে ‘দুর্বিষহ’ সময় থেকে রক্ষা পেতে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেদ ও দূরদর্শিতায় মুক্তি মিলছে দুর্বিষহ সময় থেকে। আজ থেকে পদ্মা সেতুর দ্বার খুলে গেছে; উদ্‌বোধন করলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এর পরের বার অবশ্যই পদ্মা সেতুর ওপর দিয়েই সাতক্ষীরা যাব। ও আমার স্বপ্নের পদ্মা সেতু, শুভকামনা!

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী